মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০১৪

বাংলা লেখা কেমন হবে- তিন--২০১৩


বাংলা লেখা কেমন হবে- তিন--২০১৩




বাংলাভাষা সমিতির পত্রিকা “বাভাস”
সেখানে এই লেখাটি জুন ২০১১ থেকে 
ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে৤
সেটিই এখানে আপলোড করা হল৤  





সবটা ঠিক মতো পড়তে হলে ফন্ট ফ্রি ডাউনলোড করুন এখানে ক্লিক করে:--










সঙ্গে দেওয়া ফাইল দেখে নিতে হবে৤

অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default text font setting)
Default text font setting ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং

এবং


অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট ইন্টারনেট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default Internet setting)

(Default font setting ডিফল্ট ফন্ট সেটিং)

on internet(Mozilla Firefox)
(top left) Tools  
              Options > contents
              Fonts & Colors
              Default font:=AhanLipi-Bangla14
                        Advanced...
                                    Fonts for: =Bengali
                                    Proportional = Sans Serif,   Size=20
                                    Serif=AhanLipi-Bangla14
                                    Sans Serif=AhanLipi-Bangla14
                                    Monospace=AhanLipi-Bangla14,  Size=20
                                    -->OK
            Languages
            Choose your preferred Language for displaying pages
            Choose
            Languages in order of preference
            Bengali[bn]
            -->OK
  --> OK

          এবারে ইন্টারনেট খুললে ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্টে সকলকিছু দেখা যাবে৤ নেটে একই ফন্টে সব কিছু লেখাও যাবে৤








বাংলা লেখা কেমন হবে- তিন--২০১৩



    ফেব্রুয়ারি-২০১৩ 
  
বাভাস



বাংলা লেখা কেমন হবে

মনোজকুমার দ. গিরিশ  

পর্ব-


        

প্রায়ই দেখা যায় তরকারিটা কেমন ম্যাড়মেড়ে, ঠিক যেন জুতসই লাগছে না৤ রাঁধুনিকে জিজ্ঞেস করতে সে হেসে বলল আজ গুড় একটু কম পড়েছে৤ তরকারিতে ঠিক পরিমাণ গুড় না দিলে তা তো একটু ম্যাড়মেড়ে লাগবেই৤ আমরা শাক তরকারির আসল স্বাদ ভুলেই গেছি৤ রাঁধুনিদের দুর্নাম এড়াবার জন্য গুড় তাদের সহযোগী হয়েছে৤ গুড় তাদের চাকরিটা পাকা করেছে, আর আমরা আসলের স্বাদ-বঞ্চিত হয়ে চলেছি৤ আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়ও ঠিক সেই একই ব্যাপার ঘটে চলেছে, পাকা রাঁধুনিরা চমৎকার মশলা আর গুড় সহযোগে ব্যঞ্জন পাক করছেন, আর আমরা তা খেয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছি৤ যদিও আসলের স্বাদ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছি৤ 

          সংস্কৃতের গুড় এবং সে-ব্যাকরণের মশলা দিয়ে তাঁরা আমাদের ভাষার স্বাদ এমন পালটে দিয়েছেন যে, আমরা আমাদের মূল ভাষার স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছি৤ এ ব্যাপারে চমৎকার লিখেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়৤ হ্যাঁ ঠিক, তিনিই নেপালের রাজদরবার থেকে বাংলাভাষার প্রাচীনতম উদাহরণ তুলে আমাদের সামনে এনেছেন--চর্যাচর্য বিনিশ্চয়৤ সংস্কৃতে তাঁর অগাধ জ্ঞানের কথা আমরা সকলেই জানি৤ কিন্তু তাঁর আবার তো বাংলা রোগ ছিল যেজন্য তাঁর হাতেই বাংলাভাষার প্রথম ঊষার আলো এসে ধরা দিয়েছে৤ বিষয় প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেছেন, বাংলা ভাষা প্রবন্ধটিতে শাস্ত্রী মহাশয়ের যে অন্তর্দৃষ্টি প্রকাশিত হয়েছে তা আর কোনো বাংলাভাষার আলোচনাকারীদের মধ্যে দেখিনি৤ এমন-কি রবীন্দ্রনাথও এমন কথা বলেন নি৤(হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ--পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৮১) বাংলাভাষা নিবন্ধটিতে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যা বলেছন তা সবটাই প্রায় উদ্ধৃতি হিসেবে তুলে দেওয়া দরকার৤ সেটি না পড়লে ঠিক ভাবে বোঝানো কঠিন, তিনি কী কী বলেছেন৤ এমন গভীর ভাষাবোধ অন্য কোনও রচনায় পাওয়া যায়না৤ বাংলাভাষার জন্য তাঁর গভীর প্রয়াস আমাদের মোহিত করে রাখে৤ অনেক নতুন সব কথা সেখানে আছে, পাঠকদের এটি সংগ্রহ করে অবশ্যকরে পড়ে নেওয়া উচিত৤  

          শ্রীশাস্ত্রী রচিত বাংলা ব্যাকরণ নিবন্ধটির আলোচনা প্রসঙ্গে সুকুমার সেন বলেন, বাংলা ব্যাকরণের  শব্দরূপে সংস্কৃত ও ইংরেজি ব্যাকরণের জোট মেলাবার চেষ্টা করে লেখকেরা যে বিভক্তি-কারক-case-এর ঘণ্ট পাক করে গেছেন তা এখনো  বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের গলাধঃকরণ করতে হচ্ছে৤ এই দোষের ভাগী আমিও, সুনীতিবাবুর মতো৤ সুনীতিবাবুর সঙ্গে মিলে আমিও একদা স্কুলপাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ লিখেছিলুম৤ অপরাধ যেমন স্বীকার করছি, তেমনি একথাও জোর করে বলছি যে বাংলা ব্যাকরণ আমাদের নিজস্ব চিন্তা ও গবেষণার সাহায্যে রচনা ও প্রকাশ করার কোনো উপায় ছিল না৤


          সংস্কৃত ভাষায় সুমহান খ্যাত পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী  মহাশয় বাংলা ভাষা, ‘বাংলা ব্যাকরণ’, বাংলার পুরানো অক্ষর, বাংলা সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে নিবন্ধ রচনা করেছেন৤ অর্থাৎ তিনি ছিলেন বাংলামগ্ন৤ তাঁর মৌলিক চিন্তাভাবনা মানুষকে কতটা প্রভাবিত করেছে তা খ্যাত ভাষাবেত্তা সুকুমার সেনের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে৤ বাংলা ভাষা নিয়ে বলতে গিয়ে শ্রীশাস্ত্রী বলেছেন--যাঁহারা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই৤ হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন৤ কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন৤ নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কী আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজর পড়ে নাই৤ এখন তাঁহাদের বই পড়িয়া যাঁহারা বাংলা শিখিয়াছেন, তাঁহাদের যথার্থ মাতৃভাষায় জ্ঞান সুদূরপরাহত হইয়াছে৤ অথচ ইঁহারাই যখন লেখনী ধারণ করেন, তখন মনে করেন যে, আমার বাংলা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট৤ তাঁহার বাংলা তিনি এবং তাঁহার পারিষদবর্গ বুঝিল, আর কেহ বুঝিল না৤ কেমন করিয়া বুঝিবে! সে তো দেশীয় ভাষা নহে৤ সে অনুবাদকদিগের কপোলকল্পিত ভাষার উচ্ছিষ্ট মাত্র৤ দেশের অধিকাংশ লোকই উচ্ছিষ্ট ভোজনে জাতিপাতের ভয় করে অথচ লেখকমহাশয়েরা তাহাদিগকে কুসংস্কারাপন্ন মূর্খ বলিয়া উপহাস করেন৤ এই গেল এক দলের কথা৤        


          এরপরে তিনি অন্য দলগুলির কথাও আলোচনা করেছেন৤ সংস্কৃত, ইংরেজি এবং ফার্সি(পারসি/পার্শি) জানা নানা দলের কথা তাঁর বয়ানে পরের বারে বলা যাবে৤ এযুগে তো আর এক প্রভাব জোর দেখা দিয়েছে৤ তিনি টিভির হিন্দি-যুগ দেখে যেতে পারেন নি৤

                 








    এপ্রিল-২০১৩   
 বাভাস 

বাংলা লেখা কেমন হবে
মনোজকুমার দ. গিরিশ 
পর্ব-১০
          বাংলা ব্যবহারের ইংরেজি গুমর, অর্থাৎ বাংলা শব্দের সংস্কৃতায়িত বানান প্রয়োগ-- সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলেছে৤ বাংলা বানান আর কিছুতেই ঠিক লেখা যায় না! অদাগদা করে বাংলা বানান লেখা হবে সে চলবে না! ধুতিটুতি অচল, প্যান্ট শার্ট তো চাইই কোট টাই হলেই ভালো হয়৤ ধোপদুরস্ত মার্জিত কেতাবাবু না হলে কে আর পোঁছে৤ গ্রাম্য আটপৌরে ব্যবস্থা একদম অচল৤ লাউ রাঁধা হলে তাতে একটু চিনি না দিলে সে কি আর খাবার বস্তু হয়? সে তো সোঁদা সোঁদা মেঠো হয়েই রইল হে৤ এটাই হল দস্তুর৤ বাংলাকে মেঠোবাংলা করে রাখলে চলবে না৤ কিন্তু রাখলে যে চিনি জোগানোর হ্যাপা অনেক কমত সে কথা আর কে বলে? বলার লোক তেমন বেশি নেই৤ আর যারা বলে তাদের লোকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখে-- মাথাটায় একটু ছিটই আছে!  

        তবে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে ছিটগ্রস্ত বলার এলেম কার আছে? সুকুমার সেন অবধি মিইয়ে গেছেন৤ সে কথা এর আগের বারে বলেছি৤ শাস্ত্রী মহাশয় বাংলার জন্য ভেবেছেন অনেক, লিখেছেনও অনেক, আমরা এযুগে সেসব কথা তেমন করে আর জানিনা, তাঁর কথা আলোচনা হয়না৤ হবে আর কী করে, বাংলা নিয়ে লোকের মাথাব্যথাই তো কম৤ সরকারেরই মাথাব্যথা কম বলে লোকে আর মাথা ঘামাতে চায় না৤ 

       ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ ছিল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ৤ তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে ঠিক হয় যে এবার থেকে সকল সরকারি কাজ বাংলায় করা হবে৤ তার পরে পেরিয়ে গেছে অর্ধশত বছরের বেশি এখনও সেই একই সিদ্ধান্ত নতুন করে নেওয়া চলেছেই, বরং আরও মৃদুভাষে৤ আর শতবর্ষ পেরিয়েও বোধ করি একই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৤ (অবশ্য হবে না, কারণ তখন বোধ করি তার উল্লেখ গর্হিত ব্যাপারই হয়ে দাঁড়াবে৤ এখনই তো ভয়ে ভয়ে বাংলাভাষার কথা বলতে হয়৤ কেমন আনস্মার্ট ব্যাপার স্যাপার৻)৤ 

      শাস্ত্রী মহাশয়ের যুগে(১৮৫৩-১৯৩৯) বাংলা চর্চা হত দাপটের সঙ্গে৤ তাই তিনি বাংলা নিয়ে প্রবলভাবে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন৤ সেটা রবীন্দ্রনাথের যুগ(১৮৬১-১৯৪১)৤ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যা লিখেছিলেন তা এযুগে বেশ অবিশ্বাস্য মনে হবে৤ এব্যাপারে তিনি যে দুর্মর আশা প্রকাশ করেছিলেন তা শ্রদ্ধায় স্মরণ করা যাক৤ তিনি বলেছেন__যদি এমনভাবে বঙ্গভাষার সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় যে, সম্পূর্ণরূপে মানুষ হইতে হইলে অপরাপর ভাষার ন্যায় বঙ্গভাষাও শিখিতে হয়, এবং না শিখিলে অনেক অবশ্যজ্ঞাতব্য বিষয় চিরকালের মত অজ্ঞাত থাকিয়া যায় ও অন্য শত ভাষা শিক্ষা করিয়াও পুরা মানুষ হওয়া না যায়, তবেই বঙ্গভাষা জগতে চিরস্থায়িনী হইবে; বাঙ্গলার ভাষা জগতের অন্যান্য প্রধানতম ভাষার শ্রেণীতে সমুন্নীত হইবে৤ অন্যথা বঙ্গের তথা বঙ্গভাষার গৌরব বাড়িল কৈ? বঙ্গসাহিত্য বলিলেই যাহাতে একটা বিরাট সাহিত্য বুঝায়, বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাহিত্য বুঝায়, এমনভাবে বঙ্গসাহিত্যের গঠন করিতে হইবে৤ 

     আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশাল গুম্ফশোভিত ব্যাঘ্রসদৃশ লোক এমন আবেগঋদ্ধ ভাষায় বাংলাবন্দনা করবেন তা আমরা এযুগে বসে ভাবতে পারি না৤ তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার প্রবেশে হোতা, নেতা এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক৤ সেযুগে মাইকেল, বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের কিরণে বাংলাভাষাই শুধু নয়, সারা দেশই ছিল আলোকিত৤ অতি দুঃখর কথা সে আলোক- বার্তা আমরা বহন করতে পারিনি৤ 

     দেশ ভাগ হয়েছে, বাঙালি দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে৤ সেই সাগরে বিসর্জিত হয়েছে তার ভাষাবেগ এবং আবেগ৤ বাঁচাই তার কাছে ছিল কঠিন৤ তারপরে সে যখন আবার উঠে দাঁড়াল তখন দিন অনেক পালটে গেছে৤ ততোদিনে বাংলা একটা প্রায় ব্যাকডেটেড ব্যাপার হয়ে উঠেছে৤ দেশভাগের আগে বাংলা ছিল ভারতে জনগরিষ্ঠ ভাষা৤ দেশ ভাগের পরে তা হয়ে যায় তৃতীয়৤ পরে অবশ্য তার অবস্থান দ্বিতীয় হয়েছে, কিন্তু তার সে ধার তখন আর নেই৤ ভাষার আকাশ তখন তার কাছে কেমন অন্ধকারে আচ্ছন্ন মলিন ও বিবর্ণ হয়ে গেছে৤ তার বিনোদনও তখন আর তার নিজের ভাষা বাংলা-প্রধান নয়!  অন্যের ভাষায় সে কণ্ডূয়ন করতে সদাব্যস্ত জাতি৤ 

গ্রামে অবশ্য এখনও বাংলার জোরটা আছে, কিন্তু গ্রামট্রামকে পাত্তা দেয় কে? টিভির মাধ্যমে ডুব-জলে চুবিয়ে  সেখানেও পৌঁছে গেছে অবাধ বিনোদন৤ শিশু অবধি তা কেমন দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো৤ সমাজের গঠনটাই হয়ে উঠেছে তেমনি৤ এটাই যেন অমোঘ, নিয়তি!  এর থেকে বঙ্গভাষীর উদ্ধার হবে কবে এবং কেমন করে তা কে জানে? উদ্ধার আদৌ হবে তো? অন্যরকম অতি ভয়াবহ কথাও যে শোনা গেছে অন্যত্র৤
      


    




        জুন-২০১৩    
বাভাস 


বাংলা লেখা কেমন হবে
মনোজকুমার দ. গিরিশ 

পর্ব-১১

          মানুষ যা শোনে তা-ই শেখে৤ শিশুরা তার মাতৃভাষা শেখে শুনে শুনে৤ পড়ে তো আর মাতৃভাষা শেখা যায় না, শুনে শুনেই শিখতে হয়৤ তাই তাকে জন্মের পর থেকে আমরা মুখে মুখে যা শোনাই, যা শেখাই, সে সেটাই শেখে৤ অনায়াসেই শেখে৤ কখন যে কীভাবে সে তার ভাষা শিখে নেয় তা আমাদের অবাক করে৤ আমাদের কিন্তু অবাক হবার অনেক কিছু বাকি আছে৤ অথবা হয়তো নেই! তাকে ভুলিয়ে চুপ রাখার জন্য আমরা টিভিতে কার্টুন চালিয়ে বসিয়ে দিই৤ সে বসে মনের আনন্দে তা দেখে৤ কিন্তু শুধু দেখে না, শেখেও৤ কী শেখে? শেখে বিমাতৃভাষা৤ 

     নিজের ভাষা অর্জন করার আগেই সে অন্য ভাষা রপ্ত করে ফেলে৤ এটা যে বিপদ সে কথাটাই আমরা অনেকে বুঝে উঠতে পারিনি৤ মাতৃভাষায় শিক্ষা তাই আমাদের কাছে কিছুটা হলেও অবান্তর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে৤ মানুষের সব চেয়ে বড় দুঃখের জায়গা হল মাতৃভাষা থেকে অপসারণ৤যে অপসারণ-চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রাণ দিয়ে বাংলাদেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ বিশ্বে নজির গড়ে উঠেছে৤ অথচ সেখানে এমন তো হবার কথা ছিল না৤ 

      ভারতের দুই পাশে দুটি ভূখণ্ড নিয়ে একটি দেশ তৈরি হয়েছিল৤ কিন্তু পুব অংশের মানুষের মাতৃভাষায় হাত পড়াতেই এমন কাণ্ড ঘটেছে৤ পূর্ববঙ্গে তথা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে উর্দুর মাখন মাখিয়ে বাংলার নাস্তা হচ্ছিল৤ সেটা পুব বাংলার বাঙালিরা নিজের প্রাণ দিয়ে ঠেকিয়েছে৤ সেখানে বাংলাভাষার বন্ধুর চেয়ে শত্রুই ছিল বেশি, তবু আপন প্রাণের বিনিময়ে তারা বাংলাভাষা অর্জন করেছে৤ সে অর্জন আমরা হয়তো দূরে বসে এখান থেকে তেমন বুঝতে পারব না৤ অবশ্য বুঝতে পারি এমন কোনও সদর্থক প্রয়াসও নেওয়া হয়নি৤ এটা কেবল অসতর্কতা নয়, কেবল অনুদ্যোগও নয়, এটা বস্তুত সতর্ক না হতে দেবার নিবিড় প্রয়াসও বটে৤ 



          
      সে যাক, বাংলা নিয়ে কথা বলতে গেলে কেবল বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় কথা আর সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না৤পুব বাংলায় বাঙালিরা বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে,এটা যতটা সত্য,তেমনি একথাও অতীব সত্য যে বাঙালি তার নিজের ভাষা নিয়ে ততোধিক অসচেতনও বটে৤একটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তা শুধু ভয়াবহ নয়, বাংলা ভাষার সেটা আগাম মৃত্যু সংকেতও বটে! হ্যাঁ মৃত্যুই, কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সমীক্ষা সে কথাই তুলে ধরেছে৻ 


          বাংলা ভাষার জন্য আমাদের প্রেম সকল সময়েই কেমন উথলে ওঠে৤ গদ গদ ভাষে আমরা সদা কতইনা মাতৃ(ভাষা) বন্দনা করি৤কিন্তু আদতে তার সবটাই যে মুখবাদ্য(লিপ সার্ভিস) সে কথাটা কখনও মুখে স্বীকার করি না৤ আমাদের সেই ধূর্ত অনৃত আচরণ আমরা নিজেরাই বুঝি না তো অন্যে আর কেমন করে বুঝবে? 


        সমীক্ষাটি হল--” ’বাংলা বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা হলেও, এবং ভাষার দাবিতে বাংলাভাষীরা একটি রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংগ্রাম করলেও বাংলাভাষার প্রভাব বিস্ময়কর রকমের কম বলে মনে হয়েছে প্রতিবেদনটির৤ বাংলাভাষীরা বেশিরভাগই দ্বি অথবা ত্রিভাষী৤ এবং সর্বদাই নিজের ভাষাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় দুই বা তিন নম্বরে রাখে৤ তাছাড়া বাংলায় সার্বজনীন জনপ্রিয় আধুনিক সংস্কৃতির অভাব লক্ষ করা গেছে৤ যার ফলে বিপুল জমি খেয়ে যাচ্ছে হিন্দি৤ কাজের ভাষা হয়ে ওঠার তাগিদ বাংলার কমই চিরকাল৤ ইংরেজি নির্ভরতা বেশি৤ এখন নতুন করে আর তো সম্ভব নয়৤ ফলে বাড়বে তো নাই, বাংলা ক্ষইবে৤‘ আমাদের মনে হয় অত্যন্ত নির্ভুল পর্যবেক্ষণ যতক্ষণ না পর্যন্ত বাঙালির অগ্রাধিকারের তালিকায় বাংলা ২থেকে ১নং-এ আসছে৤“__প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়৤[(’বিশ্বের ভাষাচিত্র: একটি পর্যবেক্ষণ‘-_”তবু বাংলার মুখ“৤চতুর্থ বর্ষ, প্রথমসংখ্যা, ত্রৈমাসিক, মাঘ ১৪১১, জানুয়ারি ২০০৫, পৃঃ ১৫৤) এই পর্যবেক্ষণটি উল্লেখ করে ’দেশ‘ সাহিত্যপত্রে একটি চিঠি লিখেছিলাম, এবং একটি চিত্র সহযোগে সেটি খুবই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল (২০০৫)]৤  


          বাঙালির উদ্যোগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না৤ প্রবল বেগে শুরু হয়, আর কিছুকাল পরেই তা বেগহীন হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৤ একটু লক্ষ করলেই তা অনায়াসে বোঝা যাবে৤ কিছু সংস্থা হই-হই করে তৈরি হয়েছিল, তারা আছে এখনও, তবে সেখানে আর জোয়ারের জল ঢোকে না৤ এটাই বাঙালির বৈশিষ্ট্য৤ সেই অনুদ্যোগের পিছনে সংস্থাকর্তাদের যেমন ভূমিকা আছে তেমনি সাধারণ মানুষের ভূমিকাও কম নয়৤ প্রথমে লাফঝাঁপ অনেক করে হাউই বাজির মতো তা মুহূর্তে ফুরিয়ে যায়৤ তার পরে পড়ে থাকে কেবল ধোঁয়া আর পোড়া খোল৤ কখনও বড়জোর কৌতূহলী দর্শক এক-আধজন তা দেখতে যান৤ ব্যাস্৤

     






     অক্টোবর-২০১৩  
বাভাস 

বাংলা লেখা কেমন হবে
মনোজকুমার দ. গিরিশ 

পর্ব-১২

          যে কথাটি এর আগে বলতে শুরু করেছিলাম তা আর একটু শোনা যাক৤হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫১-১৯৩১) রচনা-সংগ্রহ থেকে কিছু কথা আগেই উদ্ধৃত করেছি, তারই কিছু পুনরাবৃত্তি এবং কিছু নতুন কথা উদ্ধৃত করি৤ “যাঁহারা এ পর্যন্ত বাংলাভাষায় লেখনী ধারণ করিয়াছেন, তাঁহারা কেহই বাংলাভাষা ভালো করিয়া শিক্ষা করেন নাই৤ হয় ইংরেজি পড়িয়াছেন, না-হয় সংস্কৃত পড়িয়াছেন, পড়িয়াই অনুবাদ করিয়াছেন৤ কতকগুলি অপ্রচলিত সংস্কৃত ও নূতন গড়া চোয়ালভাঙা কথা চলিত করিয়া দিয়াছেন৤ নিজে ভাবিয়া কেহ বই লেখেন নাই, সুতরাং নিজের ভাষায় কী আছে না আছে তাহাতে তাঁহাদের নজরও পড়ে নাই৤ এখন তাঁহাদের বই পড়িয়া যাঁহারা বাংলা শিখিয়াছেন, তাঁহাদের যথার্থ মাতৃভাষায় জ্ঞান সুদূরপরাহত হইয়াছে৤ অথচ ইঁহারাই যখন লেখনী ধারণ করেন, তখন মনে করেন যে, আমার বাংলা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট৤”


          “সকলেই জানেন অতি অল্পদিন পূর্বে বাংলা ভাষায় গদ্যগ্রন্থ ছিল না, কিন্তু পদ্য প্রচুর ছিল৤ ইংরেজি শিক্ষা আরম্ভ হইবার পূর্বে যেসকল পদ্য লিখিত হইয়াছিল, তাহা বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় লিখিত৤ ... গদ্য না থাকিলেও ভদ্র সমাজে যে ভাষা প্রচলিত থাকে তাহাকেই বিশুদ্ধ বাংলাভাষা কহে৤ আমাদের দেশে সেকালে ভদ্রসমাজে তিন প্রকার বাংলাভাষা চলিত ছিল৤ মুসলমান নবাব ও ওমরাহদিগের সহিত যে-সকল ভদ্রলোকের ব্যবহার করিতে হইত, তাঁহাদের বাংলায় অনেক উর্দু শব্দ মিশানো থাকিত৤ যাঁহারা শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহাদের ভাষায় অনেক সংস্কৃত শব্দ ব্যবহৃত হইত৤...মোটামুটি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, বিষয়ী লোক, ও আদালতের লোক এই তিন দল লোকের তিন রকম বাংলা ছিল৤”


        “ইংরেজরা এ দেশ দখল করিয়া ভাষার কিছুমাত্র পরিবর্তন করিতে পারেন নাই৤কিন্তু তাঁহারা বহু-সংখ্যক আদালত স্থাপন করায় এবং আদালতে উর্দুভাষা প্রচলিত রাখায় বাংলাময় পারসি শব্দের কিছু অধিক প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল মাত্র৤ সাহেবরা পারসি শিখিতেন, বাংলা শিখিতেন৤ দেশীয়রা দেশীয় ভাষায় তাঁহাদের সহিত কথা কহিতেন৤ সুতরাং ইংরেজি কথা বাংলার মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে পারে নাই৤ যাঁহারা ইংরেজি শিখিতেন বা  ইংরেজের  সহিত  অধিক মিশিতেন দেশের মধ্যে  প্রায়ই তাঁহাদের কিছুমাত্র প্রভুত্ব থাকিত না৤” 

  “আমাদিগের দুর্ভাগ্যক্রমে যে সময়ে ইংরেজ মহাপুরুষেরা বাঙালিদিগকে বাংলা শিখাইবার জন্য উদ্যোগী হইলেন, সেই সময়ে যে-সকল পণ্ডিতের সহিত তাঁহাদের আলাপ ছিল তাঁহারা সংস্কৃত কালেজের ছাত্র৤ তখন সংস্কৃত কালেজ বাংলায় একঘরে৤ ...হঠাৎ তাঁহাদিগের উপর বাংলা পুস্তক প্রণয়নের ভার হইল৤ তাঁহারাও পণ্ডিতস্বভাবসুলভ দাম্ভিকতা সহকারে বিষয়ের গুরুত্ব কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া লেখনী ধারণ করিলেন৤ ...রাশি রাশি সংস্কৃত শব্দ বিভক্তি পরিবর্জিত হইয়া বাংলা অক্ষরে উত্তম কাগজে উত্তমরূপে মুদ্রিত হইয়া পুস্তকমধ্যে বিরাজ করিতে লাগিল৤ ... এই শ্রেণীর লেখকদের হস্তে বাংলাভাষার উন্নতির ভার অর্পিত হইল৤ লিখিত ভাষা ক্রমেই সাধারণের দুর্বোধ্য দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল৤ অথচ এডুকেশন ডেস্‌প্যাচের কল্যাণে সমস্ত বঙ্গবাসী বালক এই প্রকারের পুস্তক পড়িয়া বাংলাভাষা শিখিতে আরম্ভ করিল৤ বাংলাভাষার পরিপুষ্টির দফা একেবারে রফা হইয়া গেল৤... তাঁহারা বরফের পরিবর্তে তুষার, ফোয়ারার পরিবর্তে প্রস্রবণ,ঘূর্ণির পরিবর্তে আবর্ত, গ্রীষ্মের পরিবর্তে নিদাঘ প্রভৃতি আভাঙা সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করিয়া, গ্রন্থের গৌরব রক্ষা করিতেন৤ অনেক সময়ে তাঁহাদের ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ সংস্কৃতেও তত চলিত নহে, কেবল সংস্কৃত অভিধানে দেখিতে পাওয়া যায় মাত্র৤ এই সকল কারণ বশত,বলিয়াছিলাম যে,যাঁহারা বাংলা গ্রন্থ লিখিয়াছেন, তাঁহারা ভালো বাংলা শিখেন নাই৤ লিখিত বাংলা ও কথিত বাংলা এত তফাত হইয়া পড়িয়াছে যে, দুইটিকে এক ভাষা বলিয়াই বোধ হয় না৤ দেশের অধিকাংশ লোকেই লিখিত ভাষা বুঝিতে পারে না৤... গ্রন্থকারেরা বাংলাভাষা না শিখিয়া বাংলা লিখিতে বসিয়া এবং চলিত শব্দ সকল পরিত্যাগ করিয়া অপ্রচলিত শব্দের আশ্রয় লইয়া ভাষার যে অপকার করিয়াছেন, তাহার প্রতিকার করা শক্ত৤ ইংরেজির অতিরিক্ত চর্চা হওয়ায় বহু-সংখ্যক ইংরেজি শব্দ ও ভাব, বাংলাময় ছড়াইয়া পড়ায় বিষয়ী লোকের মধ্যে যে ভাষা প্রচলিত ছিল, তাহার এত পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে যে, পূর্বে উহা কিরূপ ছিল তাহা আর নির্ণয় করিবার জো নাই৤ গ্রন্থকারদিগের বাংলা বাংলা নহে৤ বিশুদ্ধ বাংলা কী ছিল, তাহা জানিবার উপায় নাই৤”(বাংলা ভাষা, পৃঃ ৫৫৯-৫৬৭, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ৤ ডিসেম্বর, ১৯৮১)৤ 


       ডঃ সুকুমার সেন কথাগুলি অস্বীকার করেননি বরং সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন৤

   


       

                                



      ডিসেম্বর-২০১৩     
বাভাস 


বাংলা লেখা কেমন হবে
মনোজকুমার দ. গিরিশ 

পর্ব-১৩



   যাঁরা বাংলা লেখেন তাঁরা প্রতি পদে পদে যে-সমস্যায় পড়েন তা হল বাংলা বানান৤ ভুল হলে অভিধান দেখে সংশোধন করে নিলে সমস্যা হয়তো মেটে, কিন্তু সেটা মাঝে সাঝে দু-একটি বানানের ক্ষেত্রে হলে অভিধান দেখে ভুল সংশোধন সম্ভব, কিন্তু যদি তা পদে পদে হয় তবে ভুল শোধরানোর চেষ্টায় শ্রম আছে, সুফল নেই৤ আবার কোন্ অভিধান দেখা হবে? সকল অভিধানে একই বানান নেই৤ প্রতিটি অভিধানে বানানে কিছু কিছু তফাত আছে৤ তাই অভিধান দেখেও সব সময়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন৤ সকল ইংরেজি অভিধানে শব্দের বানান নির্দিষ্ট৤ বাংলায় সেটা নয় বলেই সমস্যা আরও জটিল হয়৤ তাহলে আমাদের মতো অতি সাধারণ লোকেরা কী করবে? 


          ধরি কোথাও লেখা হল--‘মা প্রসন্য হও’ তাহলে মা প্রসন্ন হবেন, নাকি হবেন না? বানানে সঠিক না হলে মা কি হৃষ্ট হবেন না? কিন্তু যিনি লিখেছেন তিনি তো সরল মনে মায়ের সন্তুষ্টিবিধানের জন্যই লিখেছেন৤ এতে মা-র কি তুষ্ণীম্ভাব সম্ভব? এই প্রশ্নের “কি” বানান কী হবে? ‘কি‘ অথবা “কী”? পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি যে ‘আকাদেমি বানান অভিধান’ প্রকাশ করেছেন সেখানে এর একটি সুন্দর নিদান দেওয়া আছে৤ যে প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে সেখানে বানান হবে ‘কি’,  অন্যত্র “কী”৤ এটা একটা বিরাট সমাধান, নয়তো অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে কী যে লিখব তা বোঝা কঠিন৤ 


          এটা তো একটা জায়গার সমাধান, বাংলায় আছে প্রায় দেড় লক্ষ শব্দ, তাহলে বাকি সকল স্থানে কী হবে? রোমান বর্ণমালা সবচেয়ে সরল৤ তাই তা দেশে দেশে সাদরে গৃহীত হয়েছে৤ বাংলা এবং ভারতীয় অন্য সকল বর্ণমালাই জটিল বর্ণ বা কমপ্লেক্স স্ক্রিপ্ট৤ রোমান লিপিতে যেমন হরফ পরপর লিখে গেলেই শব্দ, বাক্য গঠন করা যায়৤ বাংলায় সেটা হবে না৤ হরফ, পতন, শপথ, দল, জল ইত্যাদি অল্পকিছু শব্দে সেটা হলেও এভাবে বেশি দূর লেখা যাবে না৤ বাংলায় আছে --
(১)সাধারণ হরফ ব্যবহার, 
(২)দ্বৈতীয়িক বা সেকেন্ডারি ফর্ম তথা আ-কার, ই-কার ইত্যাদি ‘কার’ চিহ্ন, 
(৩)মণ্ড হরফ বা যুক্ত বর্ণ৤ 

     ‘কার’ চিহ্নের কোনোটি বাঁয়ে, কোনোটি ডানে, আবার কোনোটি নিচে বসে, রেফ বসে হরফের মাথায়৤ হরফের চারটি দিকই এভাবে ঘিরে রাখায় লেখা জটিল হয়ে যায়৤ পড়া, বা বোঝাও অনেক সময়ে কঠিন হয়ে পড়ে৤ এক সময়ে রোমান হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু তা টেঁকেনি, কারণ একটি ভাষার থাকে এক-একটি ধ্বনি মেজাজ, তা অন্য লিপিতে ধরা খুবই কঠিন৤ তাই সে চেষ্টা বন্ধ হয়েছে৤ 

      ‘দাদা আমি দুটো ডাব খাবো’ কথাটি রোমান হরফে সঠিকভাবে লিখতে হলে চাই নানা রকম ডায়াক্রিটিক্যাল মার্ক, যাতে তা সঠিক ধ্বনি বোঝাতে পারে৤ অতিরিক্ত সেই চিহ্নাদি যদি ব্যবহার করতেই হয় তবে নিজ লিপি আর কেন বর্জন করা? 

    লিপির নিজস্ব একটা চরিত্র থাকে সেটা অন্যত্র পাওয়া যায় না৤ যেমন, ‘খেলা’ লিখে আমরা পড়ি খ্যালা, এক=এ্যাক, আবার ‘একটি’ এখন, এখুনি৤কোথাও ‘এ’, আবার কোথাও ‘এ্যা’ পড়া হচ্ছে৤ আধুনিক বাংলায় ধ্বনির অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, এবং ক্রমে হচ্ছে৤ এটা সকল ভাষার ক্ষেত্রেই ঘটে৤ ক্রমে ক্রমে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে একটু একটু করে ভাষা পালটে যায়, পালটায় লেখার রীতিও৤ 

    ভাষা হল বহতা নদীর মতো, জীবিত! কূল ভাঙে, কূল গড়ে, চড়া পড়ে৤ এককালে প্রাচীন বাংলায় যেভাবে লেখা হত, যেভাবে শব্দ বলা হত, এখন আর সেরকম বলা বা লেখা হয় না৤ মুঞি এখন লেখা হবে মুই, বর্ণ মালায় ছিল ঌ(লি), এখন আর তা নেই৤ এটাই খুব স্বাভাবিক ধারা৤ তাই আমাদের সময়ের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে এগিয়ে চলতে হবে৤ এখন যদি লেখা হয় ঌচু তবে কেউ তা লিচু পড়বে না, পড়বে নয়চু! 

    বিভিন্ন জেলায় যেমন শব্দ এবং উচ্চারণে অনেক তফাত দেখা যায়, সেটা ভাষার নিয়ম মেনেই ঘটে, কথা আছে প্রতি দশ মাইলে ভাষার একটু একটু করে পরিবর্তন ঘটে৤ তাহলে যে দেশ বিশাল তার পার্থক্যও বিশাল৤ চট্টগ্রাম তথা চাটগাঁর কথা আর বাঁকুড়া বা পুরুলিয়ার কথা পরস্পর দুর্বোধ্য যদিও তা বাংলা ভাষাই৤ এজন্য মান্য বাংলা বলা এবং লেখার চেষ্টায় পরস্পর যোগাযোগ সহজ হবে৤ 


          বাংলায় আগে ছিল ঌ, আর (ৡ)দীর্ঘ লি, (ৠ)দীর্ঘ ঋ, সেসব এখন আর নেই৤ না থাকায় দুঃখ পাবার কিছু নেই, কারণ এসবের উচ্চারণ বাংলা থেকে উঠে গেছে, কেবল হরফ রেখে তা দিয়ে কাজ তো হচ্ছেই না বরং সমস্যা হচ্ছে৤ বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার সংস্কার করেন, তাঁর তালিকায় ঌ বহাল ছিল৤ কিন্তু এটি আর ব্যবহার না হওয়াতে আপনিই উঠে গেছে৤ 

     তেমনি একটি হরফ হল অন্তঃস্থ ব(ৱ)৤ এটির বাহ্য চেহারাই কেবল আছে(তা-ও দুই ‘ব’ একই চেহারার!) কোনো প্রকৃত ব্যবহার নেই৤ পঃবঙ্গ সরকার এটি বর্ণমালা থেকে বর্জন করেছে ১৯৮১-তে৤ সন্দেহ নেই, ঠিকই করেছে৤

          





কোন মন্তব্য নেই: