ঠিক ঠিকভাবে পড়তে হলে নীচের ফন্টেই লেখাটি পড়া দরকার
বিনামূল্যে সর্বান্তিক বাংলা ইউনিকোড ফন্টটি সরাসরি ডাউনলোড করুন নীচের এই লিংকে ক্লিক করে
অহনলিপি-বাংলা১৪ (AhanLipi-Bangla14) ফন্ট Windows7 environment
সঙ্গে
দেওয়া ফাইল দেখে নিতে হবে
অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14
Default text font setting)
Default
text font setting ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং
এবং
অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট ইন্টারনেট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default Internet
setting)
(Default font setting ডিফল্ট ফন্ট সেটিং)
on
internet(Mozilla Firefox)
(top
left) Tools
Options--contents
Fonts and Colors
Default font:=AhanLipi-Bangla14
Advanced...
Fonts for:
=Bengali
Proportional
= Sans Serif, Size=20
Serif=AhanLipi-Bangla14
Sans
Serif=AhanLipi-Bangla14
Monospace=AhanLipi-Bangla14, Size=20
-- OK
Languages
Choose your preferred Language for
displaying pages
Choose
Languages in order of preference
Bengali[bn]
-- OK
-- OK
এবারে
ইন্টারনেট খুললে ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্টে সকলকিছু দেখা যাবে নেটে এই ফন্টে সব কিছু লেখাও যাবে
‘বাংলা নতুন-বানান’ রীতি প্রয়োগ করে লিখবার জন্য AALOY-Font Group.zip থেকে অতিরিক্ত কিছু ইউনিকোড ফন্ট ডাউনলোড করুন
অহনলিপি-বাংলা(AhanLipi-Bangla) কিবোর্ড ব্যবহার করতে হবে
https://sites.google.com/site/ahanlipi/home/bangla-natun-banan-font/AALOY-FontGroup2014.zipবাংলা মুদ্রণ ও
হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ
মনোজকুমার দ. গিরিশ
ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড (Nathaniel Brassey Halhed ১৭৫১-১৮৩০, জীবনকাল ৭৯ বছর) একজন ইংরেজ সাহেব তিনি ভারতের রাজধানী কোলকাতায় বসে ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজিতে একখানি বাংলা ব্যাকরণ লিখলেন কোলকাতা তখন ভারতের রাজধানী, ৫ বছর আগে ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে কোলকাতা ভারতের রাজধানী হয়েছে কোলকাতা ভারতের রাজধানী ছিল ১৩৯ বছর, ১৭৭৩ থেকে ১২ ডিসেম্বর ১৯১১ অবধি
পলাশীর যুদ্ধের ১৬ বছর পরে কোলকাতা ভারতের রাজধানী হয়
বইটির নাম ‘আ গ্রামার অব দ্য বেংগল ল্যাংগুয়েজ’(A Grammar of the Bengal Language), তখন বয়স তাঁর ২৭ বছর সেখানে বাংলা হরফে প্রচুর উদাহরণ দেখানো হল কারণ বাংলা শিখতে হলে বাংলা হরফে লেখা চেনা, জানা, বোঝা দরকার বাঙালিরা তো বাংলা হরফ চেনেই, বইখানি ইংরেজদের জন্য লেখা তারা বাংলা শিখে এদেশ যাতে ঠিক মতো শাসন করতে পারে প্রজার সঙ্গে রাজার বা রাজার কর্মচারীদের যদি সরাসরি যোগাযোগ না ঘটে তবে শাসনে বিঘ্ন ঘটে তাই এই বইটি মূলত এখানে কর্মরত ইংরেজ কর্মচারীদের বাংলা শেখাবার জন্য লেখা ও ছাপা হয়েছিল
ইংরেজরা কতখানি উদ্যোগী এবং পরিশ্রমী তার একটি বড় প্রমাণ এই বইখানি নয়তো কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে এই দেশে এসে তারা দেশ দখল আর শাসন করতে পারত না
বইখানি ছাপা হয় ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গের হুগলিতে
বইখানি যে ফিরিঙ্গিদের উপকারার্থে সে কথা বইখানিতে বলাই আছে
--- হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলিতে ছাপা বই
কী করে বইখানি ছাপা হল? কেন ছাপাছানায় দিলেই তো তারা ছেপে দেবে আজকালকার দিনে বসে এ কথা মনে হতে পারে যে বই ছাপা হওয়া আর কী কঠিন কাজ? ছাপাখানায় দিলেই হল, ছাপতে অসুবিধে কী?
সাল তারিখটা বিশেষ করে মনে রাখতে হবে সময়টা হল পলাশির যুদ্ধের ২১ বছর পরে আর দেশে তখন বাংলা ছাপাখানাই ছিল না হুগলির এন্ড্রুজ সাহেবের যে-ছাপা খানায় বইখানি ছাপা হয়, সেখানে ছাপাখানায় ইংরেজিতে ছাপার কাজ হত বাংলা ছাপার হরফই তৈরি হয়নি তখন হয়নি তো হয়নি, তা বলে উদ্যমী উদ্যোগী ইংরেজরা চুপ করে বসে থাকার পাত্র নয় তারা লেগে পড়ল কী করে বাংলা ছাপার হরফ বানানো যায় তার ব্যবস্থা করতে দেশীয় লৌহ কারিগর পঞ্চানন কর্মকারকে ধরলেন চার্লস উইলকিনস্(Charles Wilkins ১৭৪৯-১৮৩৬, জীবনকাল ৮৭ বছর) নামে একজন সাহেব তাঁর বয়স তখন ২৯ বছর, তাঁদের জন্য বাংলা হরফ লোহার উপরে ছেনি দিয়ে কেটে বানিয়ে দেবার জন্য
অনুমান করা যায় পঞ্চাননের বয়সও তখন কম ছিল [উইলকিন্স বন্ধু হালহেদের বইটি ছাপার ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হলেন ... অবশেষে চুচুঁড়ায় একটি ছোট্ট কামারশালায় তিনি সন্ধান পেলেন এক যুবকের স্বাস্থ্যবান, কৃষ্ণকায় এই যুবকটিকে তাঁর খুব পছন্দ হল নাম তার পঞ্চানন কর্মকার--মহামন ধর্মপাল, পৃঃ২০৯, বর্ণপরিচয়, নভেঃ-ডিসেঃ ২০০৯] ছাপাখানাও হুগলিতে, আর পঞ্চাননও হুগলির লোক কাছাকাছি লোক পাওয়াতে সুবিধেই হল
এক ইংরেজের বয়স ২৭, অন্য ইংরেজের ২৯ আর তরুণ পঞ্চাননের বয়স সম্ভবত ২২/২৩ হবে এই অনুমানের কারণ তরুণ ইংরজরা তরুণতর কাউকে ধরতে সাহস পেল তাদের এই “উদ্ভট” কাজ করে দেবার জন্য, নয়তো অধিক বয়স্করা যে তাদের এই “উদ্ভট” কাজের কথায় আমলই দেবে না, আর তাছাড়া, বয়স্করা তেমন উদ্যোগীও হবে না লোহা কেটে হরফ বানাবার মতো “পাগলামি” বয়স্ক লৌহ কারিগরেরা ফুঁ দিয়েই উড়িয়ে দেবে সে ভয় তো তাদের ছিলই, আবার সে হরফ হবে কিনা বাংলা হরফ, যার কোনও নজিরই নেই এই অতি অপেশাদারী কাজে “বোকা” তরুণরাই তো রাজি হতে পারে হুজ্জুতে সাহেবদের এসব ‘বোকা বোকা’ কাজে কেজো লোকেরা রাজি হবে এমন আশা ছিল না, তাই অনেক খুঁজে পঞ্চাননকে বের করতে হয়েছে পঞ্চানন রাজি হল তরুণদল নেমে পড়ল নতুন এক অভিযানে
ছেনি দিয়ে লোহা কেটে হরফ বানাবার জন্য তারা পঞ্চাননকে শেখালেন কেমন করে হরফ তথা টাইপ বানাতে হয় এ কাজটি চার্লস উইলকিনস্ কিছুটা জানতেন পঞ্চানন খুবই দক্ষ কারিগর, তিনি একটু একটু করে ধরে ধরে এক একটি বাংলা হরফ ছেনি দিয়ে লোহা কেটে তৈরি করতে থাকলেন আগে কোনও কোনও জায়গাতে বাংলা হরফে কিছু ছাপা হয়েছিল ব্লক করে, বাংলা হরফ কেমন তার উদাহরণ দেখাবার জন্য সেসব বিদেশের ব্যাপার আলগা হরফ অর্থাৎ আলাদা আলাদা হরফ বাংলায় এর আগে কখনও তৈরিই হয়নি, যাকে বলে বিচল হরফ (moveable type) সামনে কোনও উদাহরণ নেই, তবু পঞ্চানন কর্মকার অতি দক্ষতায় এক একটি করে বাংলা হরফটাইপ তৈরি করতে লাগলেন আর তা যে কতখানি সার্থক প্রায়স তা এই হরফ দিয়ে ছাপা পৃষ্ঠা দেখলে বোঝা যাবে
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ছাপা, অর্থাৎ এখন(২০১০খ্রিঃ) থেকে ২৩২বছর আগে ছাপা
একটা দুটো হরফ হলে তো আর বই ছাপা যায় না চাই পুরো বর্ণমালার টাইপ, চাই সকল যুক্তবর্ণের টাইপ এবং চাই বিভিন্ন চিহ্ন কাজটি যে কত কঠিন এবং ধৈর্য সাপেক্ষ, সময় সাপেক্ষ তা অনুমান করা যায় সে কাজটি এই ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড, চার্লস উইলকিনস্, পঞ্চানন কর্মকারের মিলিত যৌথ দলকে করতে হয়েছে এব্যাপারে যে ব্যয় তা সরকারি অনুদান হিসেবে হ্যালহেড এবং উইলকিনস্ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন
এঁরা তিনজনে মিলে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন বাংলাভাষা শুধু নয়, বাঙালি জাতির অগ্রগতিতে এই কাজ বিপুল প্রেরণা(impetus) যুগিয়েছিল বাঙালির জাগরণের এটি একটি মূল প্রেরণা/নোদনা
বইখানি তৎকালীন বাংলাভাষার অবস্থাও পাতায় পাতায় ধরে রেখেছে
কিন্তু যে-কাজটি সেখানে একটি মস্ত লক্ষ্যণীয় তা হল এর বর্ণ সংযোজন বিশেষকরে যুক্তবর্ণ সংযোজন
হাতের লেখাকে অনুসরণ করে যদিও এই টাইপ তৈরি করা হয়েছে, তবু প্রতিটি পদক্ষেপে যুক্তি ও শৃঙ্খলা স্পষ্ট ইংরেজ জাতির চরিত্র বৈশিষ্ট্য এখানে রক্ষিত হয়েছে তাঁরা বিদেশি বলে বাংলা হরফ-সংগঠন নিয়ে কোনও প্রাক-সংস্কার তথা prejudice তাঁদের ছিল না, ফলে তাঁরা বেশ সহজ যুক্তিশীল পথে অগ্রসর হয়েছেন যদিও চালু ব্যবস্থার সবটা তাঁরা ভাঙেননি বা ভাঙতে পারেননি, ভাঙতে চাননি সবটা ভাঙলে তা আর তো বাংলা থাকবে না, আর বিদেশিরা তা পড়ে ভুল বাংলা শিখবে তাই যতটা গেলে তা সহনসীমার মধ্যে থাকে তেমনভাবেই তা করা হয়েছে বিশেষ করে যুক্তবর্ণ গঠনে তারা খুবই যুক্তি(লজিক logic) মেনে চলেছেন কিন্তু আমরা বিশেদিদের সেই তথাকথিত “অযোগ্যতা, অদক্ষতা” মেনে নেইনি আমরা আবার পরবর্তী কালের ছাপায় বাংলা যুক্তবর্ণকে “যথাযথ”ভাবে দলা পাকিয়েছি, খুব করে দলা পাকিয়েছি এতে বিদেশিরা তা শিখতে পারুক, বা না পারুক সেটা আমাদের দেখার কথা নয় আমরা আমাদের বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে চেয়েছি
আমরা এখন লিখি যথাযথ পেঁচিয়ে যদিও পুরানো সেই দিনে তা সরল করা হয়েছিল, কিন্তু আমরা পরে ফিরে গেছি জটিল ব্যবস্থায় সেই সহজ সরল ভালোটা নেবার মন বা সাহস আমাদের ছিল না তাঁরা সেযুগে এটাকে করে ছিলেন আমরা এটাকে এযুগে করেছি
কেবল পিছনপানে এভাবে হাঁটার দিন, এখন আবার আমরা নতুন উদ্যমে পিছনে ফেলে যেতে চাই লেখার রীতিটাই সঠিক রীতি, এটাকে হাতে করে পেঁচিয়ে → লেখার চেষ্টায় লাভ নেই, কিন্তু লোকসান আছে অনেকই
এখানে কিন্তু ষ-এর তলায় ল লেখা হয়নি, আগেকার দিনে ণ লেখা হত তাই ষ-এর তলায় বসিয়ে লেখা হয়েছে যদিও এভাবে লেখাটা আমাদের কাছে কুযুক্তি বলে মনে হয়েছে তাই ওসব ‘ছেলেমানুষী’ বাদ দিয়ে অনায়াসে আমরা লিখেছি
কেন এভাবে লেখা হল? লেখা দেখে তো মনে হয় যেন তা, ষ+ঞ কিন্তু তা যে নয়, তা তো আমরা দেখলাম এর একটা আনুমানিক বিবর্তন আমরা কল্পনা করে দেখি(অবশ্যই সেভাবে এই বিবর্তন হয়নি, কিন্তু ভাবতে ভালো লাগল)-- এটাই হাতে করে লেখা হত , প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে তেমনই দেখা যায়
এযুগে আমাদের অনভ্যস্ত চোখে তখনকার প্রয়াস হয়তো কৌতুককর মনে হবে, কিন্তু সেটাই যে সঠিক সে উপলব্ধি এখন অন্তত আমাদের হওয়া উচিত কাল তো কত কেটে গেল, শৈশব কাটবে কবে?
একটু উদাহরণ দেখা যাক--
লাইনো টাইপে(১৯৩৫) আমরা এই রীতি ফিরে পেয়েছিলাম, সেটা কোলকাতার আনন্দবাজারে শুরু হল কিন্তু তা আবার হারিয়ে গেল ফটোটাইপ সেটিং (পিটিএস) শুরু হতেই কম্পিউটার কম্পোজিং (১৯৭৯/৮০) আমাদের আবার যুক্তবর্ণ লেখার ব্যবস্থা, বা লজিককে পিছিয়ে দিল আনন্দবাজার জানাচ্ছে তাঁদের বাংলা ফন্ট তৈরির কাজে সাহায্য করেছেন মিস ফিয়োনা রস এই ইংরেজ ভদ্রমহিলা নাকি বাংলা লাইনো টাইপ নিয়ে কাজ করছিলেন আসলে পিটিএস তথা কম্পিউটার কম্পোজিং আমাদের পিছিয়ে দিল, নাকি আমরা বিশেষ কারণে পিছিয়ে গেলাম, পিছিয়ে যেতে চাইলাম? মূল কারণটা হল পেঁচিয়ে দলা পাকিয়ে লিখলে জায়গা কিছুটা কম লাগে তাতে খরচা কম, আয় বেশি, মুনাফা বেশি ক্ষতি হল বাংলাভাষার এবং বাঙালি জাতির সেই বোধটা এখন অন্তত ফিরে আসুক
এমনি করে পেঁচিয়েই যে লিখতে হবে এমন নয়, আরও একটু যুক্তিশীল হতে বাধা নেই যেটা লাইনো টাইপে বেশ অনেকটা এসেছিল
বাংলায় যুক্তবর্ণ হয় তিন রকম (১)দুই বর্ণ (২)তিন বর্ণ (৩)চার বর্ণ দুই বর্ণের কমে তো আর যুক্তবর্ণ হতে পারে না, তেমনি চার বর্ণের বেশি বর্ণ মিলে বাংলায় যুক্তবর্ণ হয় না অন্য ভাষায় হতে পারে
দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করে আমি যুক্তবর্ণের যে তালিকা তৈরি করতে পেরেছি তাতে (১)দুই বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ২১১টি, (২)তিন বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ১৬৮টি, আর (৩)চার বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ১৬টি দুই বর্ণ =২১১, তিনবর্ণ=১৬৮, চার বর্ণ=১৬ সর্বমোট=(২১১+১৬৮+১৬=)৩৯৫ বাংলায় মোট যুক্তবর্ণ আছে অন্তত, তিনশত পঁচানব্বই
এই হিসেবে অবশ্যই হেরফের হতে পারে তা ছাড়া যুক্তবর্ণ কাকে বলব তার উপরেও এটা অনেকটা নির্ভর করে নির্ভর করে যুক্তবর্ণের প্রাচীন ধারণা এবং যুক্তবর্ণের আধুনিক ধারণার উপরেও একটি উদাহরণ দিই ‘সঙ্গীত’ শব্দটি এখন লেখা চলে ‘সংগীত’ দুই বর্ণ মিলে ‘ঙ্গ’ যুক্তবর্ণ ঠিকই, কিন্তু “ংগ” সমাবেশকে কি যুক্তবর্ণ বলা হবে, যদিও সেখানে দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিত হয়েছে? যেমন ‘অহং’ লিখতে “হং” যুক্তবর্ণ হবে কি, আবার-- অহঃ, গঁদ, রঁদা(Rodin), এখানে হঃ, গঁ, রঁ এগুলো যুক্তবর্ণ বলে গৃহীত হবে কি?
আরও মজার ব্যাপার আছে সরকার, দরকার কথাগুলি কি সর্কার, দর্কার --এভাবে লেখা যাবে? কোলকাতা কি ‘কোল্কাতা’ লেখা যাবে? যেমন লেখা যাচ্ছে উলটো, পালটা আগে লেখা হত উল্টো,পাল্টা
সুতরাং আগে দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক করতে হবে কাকে ঠিক যুক্তবর্ণ বলা হবে অর্থাৎ লেখালিখি ঠিক কীভাবে করা হবে তার উপরে নির্ভর করছে বাংলায় ক’টা যুক্তবর্ণ আছে বা হবে উৎকট, উৎপাত লিখতে যদি উত্কট, উত্পাত লিখি তবে তাতে বাধা কী? খণ্ড-ত(ৎ) তো অর্ধ-ত[কল্পনা করা যাক না-- এটি কি এমনি করে বিবর্তিত হয়েছে?], তাই সেখানে যুক্তবর্ণ করে ত্ক, ত্প লিখতে বাধা কী? ভাষা ও বানান হল একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি, সে চুক্তি মতোই তো লেখা পড়া চলবে কোনও একজনের মতের উপরে চলতে পারে না তেমন হলে বিশৃঙ্খলা হবে বাংলা বানানে যে এত গোল, তার মূল কারণ সেটাই, যে-যার নিজের মতো করে আমরা চলতে চাইছি ফলে পদে পদে বানান ভুল আসলে এটা ভুল না বলে, বিশৃঙ্খলা বলাও যায়
ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যার সদস্য ছিলেন সেই ‘পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি’(১৯৪৯) পূর্বপাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষা ও বানান নিয়ে যে সুপারিশ করেছিলেন সেই অগ্রগত, উন্নত ও কাম্য প্রয়াস কার্যকর হয়নি, করা যায়নি করলে আজ বাংলাভাষা আরও অনেক এগিয়ে যেত অবশ্য তা কার্যকর না হবার পিছনে তৎকালীন বিক্ষুব্ধ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী বাংলাভাষার প্রতি বাঙালির ভাবাবেগ এর পিছনে প্রবলভাবে কাজ করেছে
যখন বাংলায় ছাপা শুরু হয়েছিল তখনও এক বিরাট বাধা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল তা হল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ছাপাখানায় ছাপা হওয়াতে তা ধর্মপ্রাণ মানুষ বর্জন করেছিলেন কারণ? ম্লেচ্ছদের যন্ত্রের ছোঁয়া লেগে ধর্ম কলুষিত হচ্ছিল সেই কঠিন বাধা উত্তরণ করা গেছে দুরন্ত কৌশলে এখন শুনে হাস্যকর ছেলেমানুষী মনে হবে ছাপার কালির সঙ্গে পবিত্র গঙ্গা জল মিশিয়ে ছাপা শুরু করাতে ধর্মীয় গোঁড়ামি কমেছিল এই কৌশল না করলে বাংলা ছাপার কপালে অনেক দুঃখ ছিল বাংলা ভাষা ও বানানে ১৯৪৯-এর পূর্ববঙ্গীয় সংস্কারে দুর্গ্রহ কিন্তু এড়ানো যায়নি কবে কেমন করে যে যাবে, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে সেখানেও দরকার হলে গঙ্গাজল, অথবা পীরের পরা পানি ছিটোতে হবে যে রোগের যে ওষুধ জল-বিদ্যুৎ নিয়ে একবার গুজব রটেছিল যে, চাষের জন্য যে সেচের জল নদী থেকে পাওয়া যায় তার শক্তি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কালে শুষে নেওয়ায় সে-জলে কোনও কাজ হবে না[বিদ্যুতের সঙ্গে জলের কোনও সম্পর্ক নেই, জলের তীব্র বেগ কেবল বিদ্যুৎ-যন্ত্রের টারবাইন ঘোরাতে কাজে লাগানো হয়] অশিক্ষা কুশিক্ষা নিরক্ষরতার অভিশাপ আমাদের পদে পদে পিছিয়ে রাখছে সে বিপদ অতিক্রম করার সেই রকম পথই নিতে হবে যা দেশের মানুষ সহজে বুঝতে পারে, নিতে পারে অগ্রগতির স্বার্থে তাই ভাষা সংস্কার, বানান সংস্কার আটকে রাখা যাবে না রাখলে, রাখতে হলে-- জাতি পিছিয়ে পড়বে তার ঘোষিত নীতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট বিজ্ঞানী.ওআরজি biggani.org যেমন জানায়-- “প্রযুক্তি গ্রহণে দেরী করলে দেশ পিছিয়ে যাবে” অবোধেরা নাহয় সেটা বুঝবেন না, বোধসম্পন্ন মানুষেরা কেন থমকে যাবেন? ভাষা-সংস্কার, বানান-সংস্কারকাজে কেবল অবোধেরা বাধা নন, বোধসম্পন্ন মানুষেরাও মস্ত বড় বাধা কেবল তা অনুমান নয়, তেমন উদাহরণ শোনা গেছে, তেমন উদাহরণ দেখা গেছে
এযুগে আমাদের অনভ্যস্ত চোখে তখনকার প্রয়াস হয়তো কৌতুককর মনে হবে, কিন্তু সেটাই যে সঠিক সে উপলব্ধি এখন অন্তত আমাদের হওয়া উচিত কাল তো কত কেটে গেল, শৈশব কাটবে কবে?
একটু উদাহরণ দেখা যাক--
লাইনো টাইপে(১৯৩৫) আমরা এই রীতি ফিরে পেয়েছিলাম, সেটা কোলকাতার আনন্দবাজারে শুরু হল কিন্তু তা আবার হারিয়ে গেল ফটোটাইপ সেটিং (পিটিএস) শুরু হতেই কম্পিউটার কম্পোজিং (১৯৭৯/৮০) আমাদের আবার যুক্তবর্ণ লেখার ব্যবস্থা, বা লজিককে পিছিয়ে দিল আনন্দবাজার জানাচ্ছে তাঁদের বাংলা ফন্ট তৈরির কাজে সাহায্য করেছেন মিস ফিয়োনা রস এই ইংরেজ ভদ্রমহিলা নাকি বাংলা লাইনো টাইপ নিয়ে কাজ করছিলেন আসলে পিটিএস তথা কম্পিউটার কম্পোজিং আমাদের পিছিয়ে দিল, নাকি আমরা বিশেষ কারণে পিছিয়ে গেলাম, পিছিয়ে যেতে চাইলাম? মূল কারণটা হল পেঁচিয়ে দলা পাকিয়ে লিখলে জায়গা কিছুটা কম লাগে তাতে খরচা কম, আয় বেশি, মুনাফা বেশি ক্ষতি হল বাংলাভাষার এবং বাঙালি জাতির সেই বোধটা এখন অন্তত ফিরে আসুক
এমনি করে পেঁচিয়েই যে লিখতে হবে এমন নয়, আরও একটু যুক্তিশীল হতে বাধা নেই যেটা লাইনো টাইপে বেশ অনেকটা এসেছিল
বাংলায় যুক্তবর্ণ হয় তিন রকম (১)দুই বর্ণ (২)তিন বর্ণ (৩)চার বর্ণ দুই বর্ণের কমে তো আর যুক্তবর্ণ হতে পারে না, তেমনি চার বর্ণের বেশি বর্ণ মিলে বাংলায় যুক্তবর্ণ হয় না অন্য ভাষায় হতে পারে
দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান করে আমি যুক্তবর্ণের যে তালিকা তৈরি করতে পেরেছি তাতে (১)দুই বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ২১১টি, (২)তিন বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ১৬৮টি, আর (৩)চার বর্ণ মিলিয়ে যুক্তবর্ণ পয়েছি ১৬টি দুই বর্ণ =২১১, তিনবর্ণ=১৬৮, চার বর্ণ=১৬ সর্বমোট=(২১১+১৬৮+১৬=)৩৯৫ বাংলায় মোট যুক্তবর্ণ আছে অন্তত, তিনশত পঁচানব্বই
এই হিসেবে অবশ্যই হেরফের হতে পারে তা ছাড়া যুক্তবর্ণ কাকে বলব তার উপরেও এটা অনেকটা নির্ভর করে নির্ভর করে যুক্তবর্ণের প্রাচীন ধারণা এবং যুক্তবর্ণের আধুনিক ধারণার উপরেও একটি উদাহরণ দিই ‘সঙ্গীত’ শব্দটি এখন লেখা চলে ‘সংগীত’ দুই বর্ণ মিলে ‘ঙ্গ’ যুক্তবর্ণ ঠিকই, কিন্তু “ংগ” সমাবেশকে কি যুক্তবর্ণ বলা হবে, যদিও সেখানে দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিত হয়েছে? যেমন ‘অহং’ লিখতে “হং” যুক্তবর্ণ হবে কি, আবার-- অহঃ, গঁদ, রঁদা(Rodin), এখানে হঃ, গঁ, রঁ এগুলো যুক্তবর্ণ বলে গৃহীত হবে কি?
আরও মজার ব্যাপার আছে সরকার, দরকার কথাগুলি কি সর্কার, দর্কার --এভাবে লেখা যাবে? কোলকাতা কি ‘কোল্কাতা’ লেখা যাবে? যেমন লেখা যাচ্ছে উলটো, পালটা আগে লেখা হত উল্টো,পাল্টা
সুতরাং আগে দৃষ্টিভঙ্গী ঠিক করতে হবে কাকে ঠিক যুক্তবর্ণ বলা হবে অর্থাৎ লেখালিখি ঠিক কীভাবে করা হবে তার উপরে নির্ভর করছে বাংলায় ক’টা যুক্তবর্ণ আছে বা হবে উৎকট, উৎপাত লিখতে যদি উত্কট, উত্পাত লিখি তবে তাতে বাধা কী? খণ্ড-ত(ৎ) তো অর্ধ-ত[কল্পনা করা যাক না-- এটি কি এমনি করে বিবর্তিত হয়েছে?], তাই সেখানে যুক্তবর্ণ করে ত্ক, ত্প লিখতে বাধা কী? ভাষা ও বানান হল একটি অলিখিত সামাজিক চুক্তি, সে চুক্তি মতোই তো লেখা পড়া চলবে কোনও একজনের মতের উপরে চলতে পারে না তেমন হলে বিশৃঙ্খলা হবে বাংলা বানানে যে এত গোল, তার মূল কারণ সেটাই, যে-যার নিজের মতো করে আমরা চলতে চাইছি ফলে পদে পদে বানান ভুল আসলে এটা ভুল না বলে, বিশৃঙ্খলা বলাও যায়
ভাষাবিজ্ঞানী ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যার সদস্য ছিলেন সেই ‘পূর্ববঙ্গ সরকারি ভাষা কমিটি’(১৯৪৯) পূর্বপাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষা ও বানান নিয়ে যে সুপারিশ করেছিলেন সেই অগ্রগত, উন্নত ও কাম্য প্রয়াস কার্যকর হয়নি, করা যায়নি করলে আজ বাংলাভাষা আরও অনেক এগিয়ে যেত অবশ্য তা কার্যকর না হবার পিছনে তৎকালীন বিক্ষুব্ধ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী বাংলাভাষার প্রতি বাঙালির ভাবাবেগ এর পিছনে প্রবলভাবে কাজ করেছে
যখন বাংলায় ছাপা শুরু হয়েছিল তখনও এক বিরাট বাধা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল তা হল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ছাপাখানায় ছাপা হওয়াতে তা ধর্মপ্রাণ মানুষ বর্জন করেছিলেন কারণ? ম্লেচ্ছদের যন্ত্রের ছোঁয়া লেগে ধর্ম কলুষিত হচ্ছিল সেই কঠিন বাধা উত্তরণ করা গেছে দুরন্ত কৌশলে এখন শুনে হাস্যকর ছেলেমানুষী মনে হবে ছাপার কালির সঙ্গে পবিত্র গঙ্গা জল মিশিয়ে ছাপা শুরু করাতে ধর্মীয় গোঁড়ামি কমেছিল এই কৌশল না করলে বাংলা ছাপার কপালে অনেক দুঃখ ছিল বাংলা ভাষা ও বানানে ১৯৪৯-এর পূর্ববঙ্গীয় সংস্কারে দুর্গ্রহ কিন্তু এড়ানো যায়নি কবে কেমন করে যে যাবে, তা গভীরভাবে ভাবতে হবে সেখানেও দরকার হলে গঙ্গাজল, অথবা পীরের পরা পানি ছিটোতে হবে যে রোগের যে ওষুধ জল-বিদ্যুৎ নিয়ে একবার গুজব রটেছিল যে, চাষের জন্য যে সেচের জল নদী থেকে পাওয়া যায় তার শক্তি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কালে শুষে নেওয়ায় সে-জলে কোনও কাজ হবে না[বিদ্যুতের সঙ্গে জলের কোনও সম্পর্ক নেই, জলের তীব্র বেগ কেবল বিদ্যুৎ-যন্ত্রের টারবাইন ঘোরাতে কাজে লাগানো হয়] অশিক্ষা কুশিক্ষা নিরক্ষরতার অভিশাপ আমাদের পদে পদে পিছিয়ে রাখছে সে বিপদ অতিক্রম করার সেই রকম পথই নিতে হবে যা দেশের মানুষ সহজে বুঝতে পারে, নিতে পারে অগ্রগতির স্বার্থে তাই ভাষা সংস্কার, বানান সংস্কার আটকে রাখা যাবে না রাখলে, রাখতে হলে-- জাতি পিছিয়ে পড়বে তার ঘোষিত নীতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট বিজ্ঞানী.ওআরজি biggani.org যেমন জানায়-- “প্রযুক্তি গ্রহণে দেরী করলে দেশ পিছিয়ে যাবে” অবোধেরা নাহয় সেটা বুঝবেন না, বোধসম্পন্ন মানুষেরা কেন থমকে যাবেন? ভাষা-সংস্কার, বানান-সংস্কারকাজে কেবল অবোধেরা বাধা নন, বোধসম্পন্ন মানুষেরাও মস্ত বড় বাধা কেবল তা অনুমান নয়, তেমন উদাহরণ শোনা গেছে, তেমন উদাহরণ দেখা গেছে
ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের যুগে যেসকল যুক্তবর্ণ ছিল তার অনেকগুলি আর এ যুগে নেই, যেমন-- ঙ্ঙ__ , ঙ্ত্র__ , ঙ্ব__ , ঙ্য=ঙ্য__ , ঙ্ল__ , ঙ্শ__ , ঙ্ষ__ , ঙ্স__ , ঙ্হ__ , ট্ক্ষ__ , ট্শ__ , ট্ষ__ , ট্স__ , ট্হ__ , ব্ঝ__ , ষ্থ__ ইত্যাদি
এগুলির ব্যবহার সেযুগে হয়তো ছিল, কিন্তু এযুগে আর এর ব্যবহার দেখা যায় না আবার এর কতকগুলি সে-সময়ে ভিন্ন রকম করে লেখা হত, এযুগের লেখার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া ভার, যেমন-- জ্ঞ=জ্ঞ__ , ঞ্চ__ / (দ্বিতীয় রূপটি এখন চলে), ণ্ট__ , ণ্ঠ__ , ণ্ড__ , ণ্ঢ__ , ণ্ণ__, হ্ণ__ এসব বর্তমান ব্যবস্থার সঙ্গে মিলছে না, কারণ তখন ণ লেখা হত, ণ= ন্ধ__ , ব্ধ__ (প্রায় এটির মতো করেই এখনও লেখা হয়, শুধু সামনের বাহুটি আর কিছুটা নীচে নামবে),
()ষ্ণ__
()ষ্ণ__
এখন আমরা দুই হরফ মিলিয়ে দলা করে লিখলেও সে গ্রন্থে খুব স্পষ্ট করে আলাদা হরফ উপরে নীচে লেখা হত দলা পাকানো উদাহরণ কম, তবে দলা পাকানো হরফও আছে, যেমন-- ঞ্চ__ /
ষ্ণ__ এই রূপটি হাতে লেখা রূপ, ছাপার রূপ নয় এই রূপটিই এখন চলে
সেযুগে টাইপ নির্মাতারা লজিক মেনে ছাপার টাইপ তৈরি করেছেন আমরা তাঁদের আমল না দিয়ে হাতের লেখার মতো করে তৈরি টাইপে দলা পাকিয়েছি কিন্তু এসকল মণ্ড হরফ বাংলার দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কিছু কাজে লাগেনি শিশু শিক্ষার্থীদের মাথায় বোঝা চাপা ছাড়া এতে আর কিছু এগোয়নি সেযুগের তাঁরা নাহয় লজিক মানার চেয়ে হরফমণ্ড বেশি পছন্দ করতেন এযুগে আমরা কতটা কী করছি?
(সর্ব শেষ পরিমার্জন ১৬/০৪/২০১৬)
--০০--
ষ্ণ__ এই রূপটি হাতে লেখা রূপ, ছাপার রূপ নয় এই রূপটিই এখন চলে
সেযুগে টাইপ নির্মাতারা লজিক মেনে ছাপার টাইপ তৈরি করেছেন আমরা তাঁদের আমল না দিয়ে হাতের লেখার মতো করে তৈরি টাইপে দলা পাকিয়েছি কিন্তু এসকল মণ্ড হরফ বাংলার দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কিছু কাজে লাগেনি শিশু শিক্ষার্থীদের মাথায় বোঝা চাপা ছাড়া এতে আর কিছু এগোয়নি সেযুগের তাঁরা নাহয় লজিক মানার চেয়ে হরফমণ্ড বেশি পছন্দ করতেন এযুগে আমরা কতটা কী করছি?
এই ভাবে স্পষ্ট করে লেখায় বাধা কী? ঙ্ক__ ,ঙ্ক্ষ__ ,ঙ্খ__ , ঙ্গ__ ,ঙ্ঘ__ , ঞ্চ__ ,ঞ্ছ__ ,ঞ্জ__ ,ঞ্ঝ__ , ণ্ট__ ,ণ্ঠ__ , ণ্ড__ ,ণ্ঢ__ ,ণ্ণ__ , দ্গ__ ,দ্ঘ__ ,দ্ব__ (বর্তমান এবং প্রাচীন দুটি রূপ একই), দ্ভ__ ,ন্ত__ ,ন্থ__ , ন্দ__ , ন্ধ__ ,ন্ন__ , ব্জ__ ,ব্দ__ ,ব্ধ__ ,ম্প__ ,ম্ফ__ ,ম্ব__ ,ম্ভ__ ,ম্ম__ ,শ্চ__ , শ্ছ __ ,ষ্ট __,ষ্ঠ__ , ষ্ণ__ () ,স্ক__,স্খ__,স্ত__ ,স্থ__
সেই সব লেখা দেখে আজ চেনা একটু কঠিন যদিও হাতের লেখায় হরফের রূপ অনেক তাড়াতাড়ি পালটে গেলেও ছাপায় পালটায় খুব ধীরে ইংরেজিতেও ছাপার রূপ পালটেছে, যেমন, ছাপায় হ্যালহেডের বইতে ছোটহাতের s= লেখা হয়েছে দেখে এটিকে যেন মনে হয় f , যেখানে ছাপা যত আগে চালু হয়েছে সেখানে হরফের রূপ প্রায় সেই একই যায়গায় স্থির হয়ে আছে এতে লাভ এই যে প্রাচীন কালের বইপত্র পড়া কঠিন নয়, কিন্তু প্রাচীন হাতে লেখা বই বা পাণ্ডুলিপি পড়া খুব কঠিন বিশেজ্ঞরাই কেবল তা পড়তে পারেন অতি প্রাচীন মিশরের লিপির পাঠ উদ্ধার করা গেলেও এখন অবধি সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠ করা যায়নি তার অবশ্য একটি বড় কারণ হল যে, সিন্ধু সভ্যতার কোনও দ্বিভাষিক ফলকলিপি পাওয়া যায়নি যেটা মিশরে পাওয়া গেছে তাই মিশরের লিপির পাঠ উদ্ধার করা গেলেও সিন্ধুলিপি এখনও সেই অচেনার অন্ধকারেই রয়ে গেছে সিন্ধু সভ্যতায় কোনও দ্বিভাষিক ফলকলিপি যে পাওয়া যায়নি তার সম্ভাব্য কারণ হল, অন্য ভাষার মানুষদের প্রভাব এখানে পড়েনি বা সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা কখনও বিজিত হয়নি তাই দ্বিভাষিক ফলকলিপি তৈরি হয়নি সিন্ধু সভ্যতা বিলুপ্তির কারণ হতে পারে সিন্ধুনদের প্রলয়ংকর বন্যা যা এর তীর বরাবর সকল সভ্যতা মুছে দিয়েছে এসকল সভ্যতা পলিমাটির তলায় পাওয়া গেছে সম্প্রতি যেমন পাকিস্তানে সিন্ধুনদের প্রলয়ংকর বন্যায় ১৫০০ শত লোক মারা গেছে সেকালে হয়তো বন্যা আরও প্রলয়ংকর হয়েছিল, অথবা সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরালো ছিল না
আমরা এযুগে নিজেদের দিকে তাকাব, বাইরের দিকেও তাকাব লিপির গঠন এবং তার সংযুক্তরূপ যথাসম্ভব সরল করে লিখব ইংরেজিতে যেমন সরল করে লেখা হয় সেখানে যুক্তধ্বনি আছে, যা যুক্তবর্ণের প্রমাণ, তবে তা একটি লিপির ঘাড়ে আর একটি বসিয়ে নয় অতি প্রাচীন দিনে অবিকশিত সভ্যতায় মানুষ হরফের উপরে হরফ না-চাপালে তাদের যুগ্ম ধ্বনি-সংকেত অনুভব করতে পারত না তাই যুক্তধ্বনি বোঝানোর জন্য হরফের উপর হরফ চাপিয়ে যুক্ত হরফ বা যুক্তবর্ণ তৈরি করা হত প্রাচীন ভারত, মিশর ইত্যাদি সকল দেশেই তা দেখা যায় প্রাচীন ভারতে =ত্র
প্রচীন মিশরে =K L= =ক্ল, ইত্যাদি সকল দেশেই তা দেখা যায়
পরবর্তীকালে মানুষের মেধা যখন বিমূর্ত চেতনাকে ধারণ করতে শিখল, তখন হরফ পাশাপাশি বসিয়ে মানুষ যুক্তবর্ণ তৈরি করতে আরম্ভ করে, এবং এই ধরনের যুক্তবর্ণ থেকেই তারা যুক্তধ্বনি অনুভব করতে শেখে যুক্তধ্বনি বোঝাবার জন্য প্রাচীন দিনের সেই হরফের উপরে হরফ চাপানোর অপ্রত্যক্ষ স্মৃতি ইংরেজিতে এখনও খানিকটা রয়ে গেছে যেমন-- Æ æ Œ œ & ইত্যাদি কিন্তু বাংলায় রয়ে গেছে প্রায় সবটাই অর্থাৎ এ ব্যাপারে আমরা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক(!) স্তরে রয়ে গেছি আমাদের চেতনা কবে আসবে?
ব্রাহ্মীলিপি থেকে ভারতের বেশিরভাগ লিপি এসেছে, আর লিপিগুলি তার উত্তরাধিকার রক্ষা করেছে লিপির উপরে লিপি চাপিয়ে লেখার রেওয়াজ বজায় রেখে কিন্তু আর আমরা আমাদের শিশুদের উপরে অকারণ বোঝা চাপাব না, নিজেদের উপরেও অকারণ বোঝা চাপাব না, দেখা যায় অনেক যুক্তবর্ণ বড়রাও সব সময়ে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেন না সময়ের এই অপচয় রোধ করলে জাতির বিকাশে তা সহায়তা করবে লিখতে গিয়ে যদি হাতড়াতে হয় যে র-এ হ্রস্ব-উকার/দীর্ঘ-ঊকার দিলে তার হাতলটা নীচের দিকে হবে, নাকি উপরের দিকে হবে( )? এটি অবশ্য যুক্তবর্ণও নয়, সাধারণ বর্ণে উ/ঊ-কার যোগ করা হয়েছে মাত্র এই অপচয়ের কোনও ব্যাখ্যা নেই কেন যে আমরা অকারণে নিজেদের দ্বিধায় রাখতে চাই তা বোঝা ভার
আর বিদেশিরা, তাঁরা যে বাংলা আদৌ শিখেছেন এবং শিখছেন এবড় আশ্চর্য কাণ্ড! কী করে ফাদার দ্যতিয়েনের মতো গুণীজন বাংলায় এত সাবলীল দক্ষতা অর্জন করলেন তা ভেবে অবাক হতে হয় বাংলা লিখন ব্যবস্থার এই অরাজক অবস্থায়ও তাঁরা যে পিছপা হননি তার কারণ তাঁরা উদ্যমী বিদেশি, বিদেশিরাই তো বাংলা ছাপার ব্যবস্থা আমাদের মতো অনুদ্যোগী বাঙালিদের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন, নইলে যে কতকাল কেটে যেত কে জানে? বিদেশিদের সহায়তায় পেয়েছি লাইনো টাইপ, এবং বিদেশিরাই দিয়েছেন বাংলা ডিটিপি, যেটা বাংলার সবচেয়ে শোভন হরফ সেই আনন্দবাজারী টাইপ অবশ্য এটা মানতে হবে যে আনন্দবাজারের আগেই “আজকাল” প্রথম অফসেটে ছাপা শুরু করে তার প্রকাশনার শুরু থেকেই, যা ছিল পিটিএস যা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সে টাইপ দেবব্রত ঘোষ নামে একজন তরুণ বঙ্গভাষীর করা(ফোনে জানিয়েছেন, একরাম আলি, ১৫/০৯/২০১০) আসলে মূলত বিদেশি সহায়তার উপরে আমাদের এসব ব্যাপারে নির্ভর করে থাকতে হয় আমাদের ক্ষমতা বা উদ্যোগ সত্যিই তেমন উল্লেখযোগ্য কিন্তু নয়
হরফে ধাক্কাধাক্কি বা মণ্ডীকরণ বন্ধ করে তা পাশাপাশি বাসানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ইংরেজির মতো না পারলেও ‘বাংলা’র মতো করতে দোষ কী? সেই প্রস্তাবই দিতে চাই
ইংরেজিতে যেমন class, cloud, slide, slope লিখলে cl=ক্ল, sl=স্ল এই যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তা হচ্ছে হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে, তেমনি বাংলায়ও বর্ণ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ তৈরি করা যাক cl=ক্ল, sl=স্ল এসকল যুক্তবর্ণে আমরা ধরে নিতে পারি যে যুগ্মবর্ণের প্রথম হরফটি ছোট আকৃতির, আর দ্বিতীয় হরফটি স্বাভাবিক আকৃতির বাংলায় যদি আমরা লিখি-- ক্লাস, ক্লাউড, স্লাইড,স্লোপ তবে অনেকটা ইংরেজির মতোই হরফ পাশাপাশি বসিয়ে লেখা হয় এতে লিখতে, পড়তে, বুঝতে অনেক বেশি সুবিধা হয় হয়তো একদিন বাংলায়ও হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ লেখা যাবে সে দিন কিছুটা দূরে হতে পারে কিন্তু অলীক নয় ইংরেজ পাদ্রি জন মারডকের মতো আশা প্রকাশ করা যেতে পারে, "Though the proposal may now be treated with ridicule(পরিহাস), its adoption is a mere question of time." এখনও যে তেমন হচ্ছেনা তা নয়, তেমন শুরু হয়েছে, যথা-- উলটো কথা, পালটা মার, পাদরি, সরদারজি, সবজি, বাকস ইত্যাদি এক সময়ে লাইনো টাইপ চালু হবার বহুদিন পরে, লাইনোটাইপের শেষের দিকে আনন্দবাজার লিখত পারক=পার্ক এবং এমনি দলাভাঙা যুক্তবর্ণ ভালই চলছিল লেখা পরে নিন্দিত হয়ে ফিরে গেল একেবারে পুরানো সেই বিদ্যাসাগরী সাঁটে প্রথমে কিছু নিন্দা তো হবেই তা বলে এক লাফে গর্তে?
আমরা যদি সকল বাংলা যুক্তবর্ণই স্বচ্ছ-যুক্তবর্ণ রীতিতে লিখি তবে বাংলা লেখাপড়া অনেক সহজ হয়ে যাবে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি একবার আমি পুরি বেড়াতে গিয়ে প্রায় মাসখানেক সেখানে ছিলাম তাই সে সময়ে আমার মনে হল এই অবসরে এখানকার ভাষা ওডিয়া কিছুটা শিখে ফেলি সেই অনুসারে বাংলার মাধ্যমে ওডিয়া শেখার চটি বই কিনে ফেললাম পড়ে বেশ এগোচ্ছিলাম বেশ অনেকটা পড়তে পারছিলাম কিন্তু সরল বর্ণসমাবেশ পেরিয়ে যখন যুক্তবর্ণে প্রবেশ করলাম তখন পড়লাম অগাধ জলে প্রতিটি যুক্তবর্ণই যেন আলাদা আলাদা হরফ সহজ তো নয়ই, আত্মস্থ করা খুব কঠিন হল শেষে বাধ্য হলাম পড়া ছেড়ে দিতে বলা যায় ড্রপআউট হয়ে গেলাম বাংলা শিখতে গিয়ে, বাংলার শিশুরা জটিল দলা পাকানো যুক্তবর্ণ শিখতে গিয়ে কি এমনি ড্রপআউট হয় না? যে পরিবারে প্রথম-প্রজন্ম লেখাপড়া শিখতে স্কুলে গেছে, সেখানে কে তাকে সাহায্য করবে? বাংলার জটিল দলা পাকানো যুক্তবর্ণ শিখতে গিয়ে শিশুরা অবশ্যই এমনি ড্রপআউট হয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়া একটি ভালো বাঙালি ছাত্রের আক্ষেপে মূল সুরটি ধরা পড়েছে-- “উঃ, বাংলাটা কী কঠিন!” স্কুলছুট বা শিক্ষাছাড় তথা ড্রপআউটের একটি কারণ হয়ে আছে বাংলা যুক্তবর্ণ অবঙ্গভাষী বা বিদেশিদের কথা এপ্রসঙ্গে মনে রাখলে ব্যাপারটি যে আরও কত বিরাগজনক(repelling) তা সহজে বোঝা যাবে
মাতৃভাষায় যার যত দখল কম তার মেধা বা প্রতিভার বিকাশ ততো সংকুচিত হয় বাংলাভাষা যেহেতু সঠিক জীবিকা দিতে পারে না, তাই সম্পন্ন পরিবারের শিশুরা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে প্রেরিত হয় যাতে তার জীবিকার ক্ষেত্র সুবিস্তৃত হয় ইংরজি সে শিখুক, মাতৃভাষার মতো করেই শিখুক, কিন্তু মাতৃভাষার দখল পুরোপুরি থাকা দরকার তবে তার মেধা বা প্রতিভার সঠিক বিকাশ হবে মাতৃভাষায় মনের ভাব যেরকম করে প্রকাশ করা যায়, তা অন্য ভাষায় করা যায় না অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে প্রথমে মাতৃভাষায় বিষটি নিয়ে মনে মনে বক্তব্য গুছিয়ে নিয়ে মানসিভাবে তা সেই বিদেশি ভাষার তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে নিয়ে প্রকাশ করতে হয় তা অতি তাৎক্ষণিক(instant) হতে পারে, সেজন্য হয়তো মনে হতে পারে যে, তা বিদেশি ভাষাতেই সরাসরি বলা হল, কিন্তু মনে মনে মানসিক অনুবাদ হতেই থাকে মনে মনে না গুছিয়ে কিছু বলা যায় না, মনের “ভাব” মাতৃভাষায় প্রকাশ মানেও তো তা “ভাষায়” অনুদিত হচ্ছে-- ‘ভাবটি’ ভাষায় অনুদিত হচ্ছে শিশুরা ভাব গোছাতে পারে না বলেই অসংলগ্ন কথা বলে যতই দিন যায়, বয়স বাড়ে-- মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়ে, ততোই শিশু তার কথা গুছিয়ে বলতে পারে পর-ভাষায় বা বিদেশি ভাষায় মানুষ চিরকাল শিশু, তথা শিক্ষার্থী থেকে যায় এই ‘ভাব’ গোছানো মানে তা অতি তাৎক্ষণিক ‘মুখের ভাষায়’ অনুদিত হওয়া-- তা সে মাতৃভাষায় হলেও! মাতৃভাষায় যার যত দক্ষতা, যার যত অনুশীলন সে ততো সুচারুভাবে তার মনের ‘ভাব’ প্রকাশে সফল হবে যদিও মাতৃভাষা হলেই সকলকিছু সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায় না, মাতৃভাষাও গভীরভাবে অনুশীলন করা দরকার সাহিত্য যাঁরা রচনা করেন, তাঁরা সকলে সমান সফল নন, এর কারণও সেই একই, কেউ সুন্দরভাবে তা প্রকাশ করতে পারেন, কেউ সুন্দরতরভাবে তা পারেন হাত, পা, আম, জাম কাঁঠাল, বলতে পারলেই সব ভাব প্রকাশ করা যায় না--বিমূর্ত ভাব প্রকাশ করা যায় না সকল ভাষায় থাকে শব্দের তিন স্তর (১)মূর্ত শব্দ-- হাত, পা, আম, জাম কাঁঠাল, (২)অর্ধমূর্ত শব্দ-- দাদা, কাকা, বাবা, মা, পিসি, মাসি, মেসো, নতুনদাদা, (৩)বিমূর্ত শব্দ-- স্নেহ, ভালোবাসা, দয়া, উচ্ছ্বাস, গরিব, তেজ ইত্যাদি ভাষা যে-যত অনুশীলন করবে সে ততো বিমূর্ত শব্দে সমৃদ্ধ হবে, এবং ততোই সে মনের ভাবসমূহ প্রকাশে দক্ষ হবে যে ভাষায় বিমূর্ত শব্দ যত বেশি, সে ভাষা ততো সমৃদ্ধ
অনেক ইংরেজি শব্দের যেমন বাংলা হয় না, তা ইংরেজি করেই প্রকাশ করা সহজ, তেমনি মাতৃভাষার অনেক ভাব ইংরেজি করে বলা খুব কঠিন, অনুবাদ করে তা মোটামুটি কাছাকাছি করা সম্ভব এজন্য কবিতার সঠিক অনুবাদ হয় না, যেটা হয় সেটা মোটামুটি ভাবানুবাদ এমনকি তেমন বৈভবসম্পন্ন গদ্য হলেও তার সঠিক অনুবাদ করা কঠিন রবীন্দ্রনাথের “বাংলাভাষা- পরিচয়” বইটি কম বয়স্ক তরুণদের জন্য রচিত, তার ভাষাও বেশ সরল, কিন্তু ঠিক যেন তা সমুদ্র-বেলাভূমির মতো, জলে বহু দূর গেলেও হাঁটু ডোবে না, কিন্তু এগোতে এগোতে একটু একটু করে এক সময়ে আর তল পাওয়া যায় না সেখানে সুচারু অনুবাদ হবে কেমন করে? কোন একটি বিশেষ শব্দ নয়, সামগ্রিক ভাবটি যেন চেতনাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে
এখানে c বা C হল consonant তথা ব্যঞ্জনবর্ণ c1 হল ছোট আয়তনের বর্ণ, আর C2 হল বড় আয়তনের বর্ণ প্রথম সূত্রটিতে বোঝানো হচ্ছে দুই বর্ণের মিলন, তার প্রথমটি ছোট মাপের হরফ, আর দ্বিতীয়টি বড় মাপের হরফ এবং দ্বিতীয় সূত্রটিতে বোঝানো হচ্ছে তিন বর্ণের মিলন, তার প্রথম দুটি ছোট মাপের হরফ, আর শেষেরটি বড় মাপের হরফ এখানে ইংরেজিতে মাপটি ঠিক যেমন গঠনের, বাংলায় যুক্তবর্ণের হরফ যোজনাও ঠিক তেমনি ধরনের হবে ইংরেজি হরফে মাত্রা নেই, বাংলা হরফে মাত্রা আছে, এখানে বাংলায় ছোট বড় মাপের দুটি হরফই পাশাপাশি বসবে এবং দুটির মাত্রাই একই রেখায় হবে
সেই সব লেখা দেখে আজ চেনা একটু কঠিন যদিও হাতের লেখায় হরফের রূপ অনেক তাড়াতাড়ি পালটে গেলেও ছাপায় পালটায় খুব ধীরে ইংরেজিতেও ছাপার রূপ পালটেছে, যেমন, ছাপায় হ্যালহেডের বইতে ছোটহাতের s= লেখা হয়েছে দেখে এটিকে যেন মনে হয় f , যেখানে ছাপা যত আগে চালু হয়েছে সেখানে হরফের রূপ প্রায় সেই একই যায়গায় স্থির হয়ে আছে এতে লাভ এই যে প্রাচীন কালের বইপত্র পড়া কঠিন নয়, কিন্তু প্রাচীন হাতে লেখা বই বা পাণ্ডুলিপি পড়া খুব কঠিন বিশেজ্ঞরাই কেবল তা পড়তে পারেন অতি প্রাচীন মিশরের লিপির পাঠ উদ্ধার করা গেলেও এখন অবধি সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠ করা যায়নি তার অবশ্য একটি বড় কারণ হল যে, সিন্ধু সভ্যতার কোনও দ্বিভাষিক ফলকলিপি পাওয়া যায়নি যেটা মিশরে পাওয়া গেছে তাই মিশরের লিপির পাঠ উদ্ধার করা গেলেও সিন্ধুলিপি এখনও সেই অচেনার অন্ধকারেই রয়ে গেছে সিন্ধু সভ্যতায় কোনও দ্বিভাষিক ফলকলিপি যে পাওয়া যায়নি তার সম্ভাব্য কারণ হল, অন্য ভাষার মানুষদের প্রভাব এখানে পড়েনি বা সিন্ধু সভ্যতার লোকেরা কখনও বিজিত হয়নি তাই দ্বিভাষিক ফলকলিপি তৈরি হয়নি সিন্ধু সভ্যতা বিলুপ্তির কারণ হতে পারে সিন্ধুনদের প্রলয়ংকর বন্যা যা এর তীর বরাবর সকল সভ্যতা মুছে দিয়েছে এসকল সভ্যতা পলিমাটির তলায় পাওয়া গেছে সম্প্রতি যেমন পাকিস্তানে সিন্ধুনদের প্রলয়ংকর বন্যায় ১৫০০ শত লোক মারা গেছে সেকালে হয়তো বন্যা আরও প্রলয়ংকর হয়েছিল, অথবা সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরালো ছিল না
আমরা এযুগে নিজেদের দিকে তাকাব, বাইরের দিকেও তাকাব লিপির গঠন এবং তার সংযুক্তরূপ যথাসম্ভব সরল করে লিখব ইংরেজিতে যেমন সরল করে লেখা হয় সেখানে যুক্তধ্বনি আছে, যা যুক্তবর্ণের প্রমাণ, তবে তা একটি লিপির ঘাড়ে আর একটি বসিয়ে নয় অতি প্রাচীন দিনে অবিকশিত সভ্যতায় মানুষ হরফের উপরে হরফ না-চাপালে তাদের যুগ্ম ধ্বনি-সংকেত অনুভব করতে পারত না তাই যুক্তধ্বনি বোঝানোর জন্য হরফের উপর হরফ চাপিয়ে যুক্ত হরফ বা যুক্তবর্ণ তৈরি করা হত প্রাচীন ভারত, মিশর ইত্যাদি সকল দেশেই তা দেখা যায় প্রাচীন ভারতে =ত্র
প্রচীন মিশরে =K L= =ক্ল, ইত্যাদি সকল দেশেই তা দেখা যায়
পরবর্তীকালে মানুষের মেধা যখন বিমূর্ত চেতনাকে ধারণ করতে শিখল, তখন হরফ পাশাপাশি বসিয়ে মানুষ যুক্তবর্ণ তৈরি করতে আরম্ভ করে, এবং এই ধরনের যুক্তবর্ণ থেকেই তারা যুক্তধ্বনি অনুভব করতে শেখে যুক্তধ্বনি বোঝাবার জন্য প্রাচীন দিনের সেই হরফের উপরে হরফ চাপানোর অপ্রত্যক্ষ স্মৃতি ইংরেজিতে এখনও খানিকটা রয়ে গেছে যেমন-- Æ æ Œ œ & ইত্যাদি কিন্তু বাংলায় রয়ে গেছে প্রায় সবটাই অর্থাৎ এ ব্যাপারে আমরা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক(!) স্তরে রয়ে গেছি আমাদের চেতনা কবে আসবে?
ব্রাহ্মীলিপি থেকে ভারতের বেশিরভাগ লিপি এসেছে, আর লিপিগুলি তার উত্তরাধিকার রক্ষা করেছে লিপির উপরে লিপি চাপিয়ে লেখার রেওয়াজ বজায় রেখে কিন্তু আর আমরা আমাদের শিশুদের উপরে অকারণ বোঝা চাপাব না, নিজেদের উপরেও অকারণ বোঝা চাপাব না, দেখা যায় অনেক যুক্তবর্ণ বড়রাও সব সময়ে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেন না সময়ের এই অপচয় রোধ করলে জাতির বিকাশে তা সহায়তা করবে লিখতে গিয়ে যদি হাতড়াতে হয় যে র-এ হ্রস্ব-উকার/দীর্ঘ-ঊকার দিলে তার হাতলটা নীচের দিকে হবে, নাকি উপরের দিকে হবে( )? এটি অবশ্য যুক্তবর্ণও নয়, সাধারণ বর্ণে উ/ঊ-কার যোগ করা হয়েছে মাত্র এই অপচয়ের কোনও ব্যাখ্যা নেই কেন যে আমরা অকারণে নিজেদের দ্বিধায় রাখতে চাই তা বোঝা ভার
আর বিদেশিরা, তাঁরা যে বাংলা আদৌ শিখেছেন এবং শিখছেন এবড় আশ্চর্য কাণ্ড! কী করে ফাদার দ্যতিয়েনের মতো গুণীজন বাংলায় এত সাবলীল দক্ষতা অর্জন করলেন তা ভেবে অবাক হতে হয় বাংলা লিখন ব্যবস্থার এই অরাজক অবস্থায়ও তাঁরা যে পিছপা হননি তার কারণ তাঁরা উদ্যমী বিদেশি, বিদেশিরাই তো বাংলা ছাপার ব্যবস্থা আমাদের মতো অনুদ্যোগী বাঙালিদের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন, নইলে যে কতকাল কেটে যেত কে জানে? বিদেশিদের সহায়তায় পেয়েছি লাইনো টাইপ, এবং বিদেশিরাই দিয়েছেন বাংলা ডিটিপি, যেটা বাংলার সবচেয়ে শোভন হরফ সেই আনন্দবাজারী টাইপ অবশ্য এটা মানতে হবে যে আনন্দবাজারের আগেই “আজকাল” প্রথম অফসেটে ছাপা শুরু করে তার প্রকাশনার শুরু থেকেই, যা ছিল পিটিএস যা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সে টাইপ দেবব্রত ঘোষ নামে একজন তরুণ বঙ্গভাষীর করা(ফোনে জানিয়েছেন, একরাম আলি, ১৫/০৯/২০১০) আসলে মূলত বিদেশি সহায়তার উপরে আমাদের এসব ব্যাপারে নির্ভর করে থাকতে হয় আমাদের ক্ষমতা বা উদ্যোগ সত্যিই তেমন উল্লেখযোগ্য কিন্তু নয়
হরফে ধাক্কাধাক্কি বা মণ্ডীকরণ বন্ধ করে তা পাশাপাশি বাসানোর উদ্যোগ নেওয়া দরকার ইংরেজির মতো না পারলেও ‘বাংলা’র মতো করতে দোষ কী? সেই প্রস্তাবই দিতে চাই
ইংরেজিতে যেমন class, cloud, slide, slope লিখলে cl=ক্ল, sl=স্ল এই যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তা হচ্ছে হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে, তেমনি বাংলায়ও বর্ণ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ তৈরি করা যাক cl=ক্ল, sl=স্ল এসকল যুক্তবর্ণে আমরা ধরে নিতে পারি যে যুগ্মবর্ণের প্রথম হরফটি ছোট আকৃতির, আর দ্বিতীয় হরফটি স্বাভাবিক আকৃতির বাংলায় যদি আমরা লিখি-- ক্লাস, ক্লাউড, স্লাইড,স্লোপ তবে অনেকটা ইংরেজির মতোই হরফ পাশাপাশি বসিয়ে লেখা হয় এতে লিখতে, পড়তে, বুঝতে অনেক বেশি সুবিধা হয় হয়তো একদিন বাংলায়ও হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে যুক্তধ্বনি বা যুক্তবর্ণ লেখা যাবে সে দিন কিছুটা দূরে হতে পারে কিন্তু অলীক নয় ইংরেজ পাদ্রি জন মারডকের মতো আশা প্রকাশ করা যেতে পারে, "Though the proposal may now be treated with ridicule(পরিহাস), its adoption is a mere question of time." এখনও যে তেমন হচ্ছেনা তা নয়, তেমন শুরু হয়েছে, যথা-- উলটো কথা, পালটা মার, পাদরি, সরদারজি, সবজি, বাকস ইত্যাদি এক সময়ে লাইনো টাইপ চালু হবার বহুদিন পরে, লাইনোটাইপের শেষের দিকে আনন্দবাজার লিখত পারক=পার্ক এবং এমনি দলাভাঙা যুক্তবর্ণ ভালই চলছিল লেখা পরে নিন্দিত হয়ে ফিরে গেল একেবারে পুরানো সেই বিদ্যাসাগরী সাঁটে প্রথমে কিছু নিন্দা তো হবেই তা বলে এক লাফে গর্তে?
আমরা যদি সকল বাংলা যুক্তবর্ণই স্বচ্ছ-যুক্তবর্ণ রীতিতে লিখি তবে বাংলা লেখাপড়া অনেক সহজ হয়ে যাবে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি একবার আমি পুরি বেড়াতে গিয়ে প্রায় মাসখানেক সেখানে ছিলাম তাই সে সময়ে আমার মনে হল এই অবসরে এখানকার ভাষা ওডিয়া কিছুটা শিখে ফেলি সেই অনুসারে বাংলার মাধ্যমে ওডিয়া শেখার চটি বই কিনে ফেললাম পড়ে বেশ এগোচ্ছিলাম বেশ অনেকটা পড়তে পারছিলাম কিন্তু সরল বর্ণসমাবেশ পেরিয়ে যখন যুক্তবর্ণে প্রবেশ করলাম তখন পড়লাম অগাধ জলে প্রতিটি যুক্তবর্ণই যেন আলাদা আলাদা হরফ সহজ তো নয়ই, আত্মস্থ করা খুব কঠিন হল শেষে বাধ্য হলাম পড়া ছেড়ে দিতে বলা যায় ড্রপআউট হয়ে গেলাম বাংলা শিখতে গিয়ে, বাংলার শিশুরা জটিল দলা পাকানো যুক্তবর্ণ শিখতে গিয়ে কি এমনি ড্রপআউট হয় না? যে পরিবারে প্রথম-প্রজন্ম লেখাপড়া শিখতে স্কুলে গেছে, সেখানে কে তাকে সাহায্য করবে? বাংলার জটিল দলা পাকানো যুক্তবর্ণ শিখতে গিয়ে শিশুরা অবশ্যই এমনি ড্রপআউট হয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়া একটি ভালো বাঙালি ছাত্রের আক্ষেপে মূল সুরটি ধরা পড়েছে-- “উঃ, বাংলাটা কী কঠিন!” স্কুলছুট বা শিক্ষাছাড় তথা ড্রপআউটের একটি কারণ হয়ে আছে বাংলা যুক্তবর্ণ অবঙ্গভাষী বা বিদেশিদের কথা এপ্রসঙ্গে মনে রাখলে ব্যাপারটি যে আরও কত বিরাগজনক(repelling) তা সহজে বোঝা যাবে
মাতৃভাষায় যার যত দখল কম তার মেধা বা প্রতিভার বিকাশ ততো সংকুচিত হয় বাংলাভাষা যেহেতু সঠিক জীবিকা দিতে পারে না, তাই সম্পন্ন পরিবারের শিশুরা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলে প্রেরিত হয় যাতে তার জীবিকার ক্ষেত্র সুবিস্তৃত হয় ইংরজি সে শিখুক, মাতৃভাষার মতো করেই শিখুক, কিন্তু মাতৃভাষার দখল পুরোপুরি থাকা দরকার তবে তার মেধা বা প্রতিভার সঠিক বিকাশ হবে মাতৃভাষায় মনের ভাব যেরকম করে প্রকাশ করা যায়, তা অন্য ভাষায় করা যায় না অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে হলে প্রথমে মাতৃভাষায় বিষটি নিয়ে মনে মনে বক্তব্য গুছিয়ে নিয়ে মানসিভাবে তা সেই বিদেশি ভাষার তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে নিয়ে প্রকাশ করতে হয় তা অতি তাৎক্ষণিক(instant) হতে পারে, সেজন্য হয়তো মনে হতে পারে যে, তা বিদেশি ভাষাতেই সরাসরি বলা হল, কিন্তু মনে মনে মানসিক অনুবাদ হতেই থাকে মনে মনে না গুছিয়ে কিছু বলা যায় না, মনের “ভাব” মাতৃভাষায় প্রকাশ মানেও তো তা “ভাষায়” অনুদিত হচ্ছে-- ‘ভাবটি’ ভাষায় অনুদিত হচ্ছে শিশুরা ভাব গোছাতে পারে না বলেই অসংলগ্ন কথা বলে যতই দিন যায়, বয়স বাড়ে-- মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়ে, ততোই শিশু তার কথা গুছিয়ে বলতে পারে পর-ভাষায় বা বিদেশি ভাষায় মানুষ চিরকাল শিশু, তথা শিক্ষার্থী থেকে যায় এই ‘ভাব’ গোছানো মানে তা অতি তাৎক্ষণিক ‘মুখের ভাষায়’ অনুদিত হওয়া-- তা সে মাতৃভাষায় হলেও! মাতৃভাষায় যার যত দক্ষতা, যার যত অনুশীলন সে ততো সুচারুভাবে তার মনের ‘ভাব’ প্রকাশে সফল হবে যদিও মাতৃভাষা হলেই সকলকিছু সুন্দরভাবে প্রকাশ করা যায় না, মাতৃভাষাও গভীরভাবে অনুশীলন করা দরকার সাহিত্য যাঁরা রচনা করেন, তাঁরা সকলে সমান সফল নন, এর কারণও সেই একই, কেউ সুন্দরভাবে তা প্রকাশ করতে পারেন, কেউ সুন্দরতরভাবে তা পারেন হাত, পা, আম, জাম কাঁঠাল, বলতে পারলেই সব ভাব প্রকাশ করা যায় না--বিমূর্ত ভাব প্রকাশ করা যায় না সকল ভাষায় থাকে শব্দের তিন স্তর (১)মূর্ত শব্দ-- হাত, পা, আম, জাম কাঁঠাল, (২)অর্ধমূর্ত শব্দ-- দাদা, কাকা, বাবা, মা, পিসি, মাসি, মেসো, নতুনদাদা, (৩)বিমূর্ত শব্দ-- স্নেহ, ভালোবাসা, দয়া, উচ্ছ্বাস, গরিব, তেজ ইত্যাদি ভাষা যে-যত অনুশীলন করবে সে ততো বিমূর্ত শব্দে সমৃদ্ধ হবে, এবং ততোই সে মনের ভাবসমূহ প্রকাশে দক্ষ হবে যে ভাষায় বিমূর্ত শব্দ যত বেশি, সে ভাষা ততো সমৃদ্ধ
অনেক ইংরেজি শব্দের যেমন বাংলা হয় না, তা ইংরেজি করেই প্রকাশ করা সহজ, তেমনি মাতৃভাষার অনেক ভাব ইংরেজি করে বলা খুব কঠিন, অনুবাদ করে তা মোটামুটি কাছাকাছি করা সম্ভব এজন্য কবিতার সঠিক অনুবাদ হয় না, যেটা হয় সেটা মোটামুটি ভাবানুবাদ এমনকি তেমন বৈভবসম্পন্ন গদ্য হলেও তার সঠিক অনুবাদ করা কঠিন রবীন্দ্রনাথের “বাংলাভাষা- পরিচয়” বইটি কম বয়স্ক তরুণদের জন্য রচিত, তার ভাষাও বেশ সরল, কিন্তু ঠিক যেন তা সমুদ্র-বেলাভূমির মতো, জলে বহু দূর গেলেও হাঁটু ডোবে না, কিন্তু এগোতে এগোতে একটু একটু করে এক সময়ে আর তল পাওয়া যায় না সেখানে সুচারু অনুবাদ হবে কেমন করে? কোন একটি বিশেষ শব্দ নয়, সামগ্রিক ভাবটি যেন চেতনাকে মোহমুগ্ধ করে রাখে
বাংলা যুক্তবর্ণের সূত্র হবে দুটি
এখানে c বা C হল consonant তথা ব্যঞ্জনবর্ণ c1 হল ছোট আয়তনের বর্ণ, আর C2 হল বড় আয়তনের বর্ণ প্রথম সূত্রটিতে বোঝানো হচ্ছে দুই বর্ণের মিলন, তার প্রথমটি ছোট মাপের হরফ, আর দ্বিতীয়টি বড় মাপের হরফ এবং দ্বিতীয় সূত্রটিতে বোঝানো হচ্ছে তিন বর্ণের মিলন, তার প্রথম দুটি ছোট মাপের হরফ, আর শেষেরটি বড় মাপের হরফ এখানে ইংরেজিতে মাপটি ঠিক যেমন গঠনের, বাংলায় যুক্তবর্ণের হরফ যোজনাও ঠিক তেমনি ধরনের হবে ইংরেজি হরফে মাত্রা নেই, বাংলা হরফে মাত্রা আছে, এখানে বাংলায় ছোট বড় মাপের দুটি হরফই পাশাপাশি বসবে এবং দুটির মাত্রাই একই রেখায় হবে
-----বাংলায় চার বর্ণের মিলন প্রকৃতপক্ষে গিয়ে দাঁড়ায়, তিন বর্ণেরই হেরফের এ সবের উদাহরণ দেখা যাক-- (১)c1C2 -- ক্+ক → ক্ক → পাক্কা, ঙ্+গ → ঙ্গ → বঙ্গ, ট্+ট → ট্ট → পাট্টা
(২)c1c1C2 -- ন্+দ+র=ন্দ্র → চন্দ্র, স্+প্+ল → স্প্ল → স্প্লেনডিড, স্প্লিট
এই রীতিতে চলতি অভ্যাসে বেশ কিছুটা ধাক্কা লাগবে, কিন্তু দলাপাকানো হরফের চেয়ে তা অনেক সহজ হবে মণ্ড হরফের জটিলতা এতে অপসারিত হয়ে তা সহজবোধ্য হবে
এই রীতির একটা বড় সুবিধা হল এই যে যাঁরা বাংলা কম্পিউটার ফন্ট নির্মাণ করতে চান তাঁরা অনেক সহজে সকল যুক্তবর্ণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ভবিষ্যতে যদি অন্য ভাষা থেকে আগত ধ্বনির জন্য নতুন নতুন যুক্তবর্ণ লিখতে হয় তবুও তা সহজে লেখা যাবে, ফন্ট সফ্টওয়্যার সংশোধন করতে হবেনা দলা পাকানো হরফমণ্ড তৈরি করতে হবে না কারণ এই রীতির পরিসর সুদূর বিস্তৃত, সেখানে বিচরণ করা যাবে অবাধে ফন্ট সফ্টওয়্যার হবে অনেক কম আয়তনের, এবং নির্মিতিতে অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ, সরল দেখা যাচ্ছে চলতি বাংলা ইউনিকোড ফন্টে যেখানে মণ্ড যুক্তবর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি ৩ থেকে ৬গুণ বেশি বড় হয় এই উদ্দিষ্ট ফন্টের আয়তন ৮৮ কেবি, আর অন্য ফন্টের আয়তন ২২৭ কেবি থেকে ৪৭৮ কেবি, বা কিছু কমবেশি
দেখা যাক বাংলা যুক্তবর্ণ কেমন গঠনের হবে--
দুই বর্ণ:--
ক্ক, ক্ট, ক্ত, ক্ন, ক্ম, ক্য, ক্র, ক্ল, ক্ব, ক্ষ, ক্স, খ্ম, খ্য, ক্র, গ্দ, গ্ধ, গ্ন, গ্ম, গ্য, গ্র, গ্ল, গ্ব, ঘ্ন, ঘ্য, গ্র, ঘ্ব, ঙ্ক, ঙ্খ, ঙ্গ, ঙ্ঘ, ঙ্ম, চ্চ, চ্ছ, চ্ঞ, চ্য, ছ্য, জ্জ, জ্ঝ, জ্ঞ, জ্য, জ্র, জ্ব, ঞ্চ, ঞ্ছ, ঞ্জ, ঞ্ঝ, ঞ্য, ট্ট, ট্ম, ট্য, ট্র, ট্ব, ঠ্ব, ড্ড, ড্ম, ড্য, ড্র, ড্ব, ফ্য, ঢ্র, ণ্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ঢ, ণ্ণ, ণ্ম, ণ্য, ণ্ব, ত্ত, ত্থ, ত্ন, ত্ম, ত্য, ত্র, ত্ব, থ্য, থ্র, থ্ব, দ্গ, দ্ঘ, দ্দ, দ্ধ, দ্ভ, দ্ম, দ্য, দ্য, দ্র, দ্ব, ধ্ন, ধ্ম, ধ্য, ধ্র, ধ্ব, ন্ট, ন্ড, ন্ত, ন্থ, ন্দ, ন্ধ, ন্ন, ন্ম, ন্য, ন্ব, ন্স, প্ট, প্ত, প্ন, প্প, প্য, প্র, প্ল, প্স, ফ্র, ফ্ল, ব্জ, ব্দ, ব্ধ, ব্ব, ব্ল, ভ্য, ভ্র, ভ্ল, ম্ন, ম্প, ম্ফ, ম্ব, ম্ভ, ম্ম, ম্য, ম্র, ম্ল, য্য, ঋর্, র্ক, র্খ, র্গ, র্ঘ, র্চ, র্ছ, র্জ, র্ঝ, র্ট, র্ড, র্ণ, র্ত, র্থ, র্দ, র্ধ, র্ন, র্প, র্ফ, র্ভ, র্ম, র্য, র্র, র্ল, র্ব, র্শ, র্ষ, র্স, র্হ, ৎর্ , ল্ক, ল্গ, ল্ট, ল্ড, ল্প, ল্ফ, ল্ম, ল্য, ল্ল, ল্ব, ব্য, ব্র, শ্চ, শ্ছ, শ্ন, শ্ম, শ্য, শ্র, শ্ল, শ্ব, ষ্ক, ষ্ট, ষ্ঠ, ষ্ণ, ষ্প, ষ্ফ, ষ্ম, ষ্য, ষ্ব, স্ক, স্খ, স্ট, স্ত, স্থ, স্ন, স্প, স্ফ, স্ম, স্য, স্র, স্ল, স্ব, হ্ণ, হ্ন, হ্ম, হ্য, হ্র, হ্ল, হ্ব, ড়্গ = ২১১টি
এখানে দ্য এবং ঋর্ -- এই দুটি গণনা থেকে বাদ, কারণ দ্য [দ+য=দ্য]একবার গণনা করা হয়েছে ঋর্ যুক্ত বর্ণ নয়, কারণ এখানে স্বরবর্ণে ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হয়েছে র+ঋ → র্+ঋ → র্ +ঋ=ঋর্ যেমন কা, কৃ, কো এগুলি যুক্তবর্ণ নয় বিভ্রান্তি হবার কারণ হল র-বর্ণটি রেফ চিহ্ন হয়ে ঋ-এর উপরে বসেছে
তিন বর্ণ:--
ক্ট্র, ক্ত্য, ক্ত্র, ক্ন্য, ক্যং, ক্রং, ক্ল্য, ক্ষ্ণ, ক্ষ্ম, ক্ষ্য, ক্ষ্ব, ক্ষং, ক্ষঃ, ক্ষঁ, গ্ধ্য, গ্ন্য, গ্নং, গ্র্য, ঘ্ন্য, ঙ্ক্য, ঙ্ক্র, ঙ্ক্ষ, ঙ্খ্য, ঙ্গ্য, ঙ্গঃ, ঙ্ঘ্য, ঙ্ঘ্র, ঙ্ঘঃ, চ্চঃ, চ্ছ্র, চ্ছ্ব, জ্জ্ব, ণ্ঠ্য, ণ্ড্য, ণ্ড্র, ত্ত্য, ত্ত্র, ত্ত্ব, ত্ন্য, ত্ম্য, ত্যং, ত্র্য, ত্রং, দ্দ্য, দ্দ্ব, দ্দং, দ্ধ্য, দ্ধ্র, দ্ধ্ব, দ্ভ্র, দ্যঃ, দ্র্য, দ্রং, দ্ব্য, দ্বং, ধ্বং, ন্ট্র, ন্টং, ন্ড্র, ন্ত্য, ন্ত্র, ন্ত্ব, ন্তঃ, ন্দ্য, ন্দ্র, ন্দ্ব, ন্দং, ন্দঃ, ন্ধ্য, ন্ধ্র, ন্ধঃ, ন্ন্য, প্ত্র, প্রং, ফ্রঁ, ব্ধ্য, ব্ধ্র, ব্বঃ, ব্ভ্র, ব্রঁ, ব্ল্য, ভ্যং, ভ্রং, ম্প্য, ম্প্র, ম্পং, ম্ব্র, ম্ভ্র, ম্ভঃ, র্ক্ত, র্ক্য, র্গ্য, র্গ্র, র্ঘ্য, র্ঙ্গ, র্চ্ছ, র্চ্য, র্চঃ, র্জ্ঞ, র্জ্য, র্জঃ, র্ট্র, র্ঢ্য, র্ণ্য, র্ণঃ, র্ত্ম, র্ত্য, র্ত্র, র্থ্য, র্থং, র্দ্ধ, র্দ্য, র্দ্র, র্দ্ব, র্দঃ, র্ধ্য, র্ধ্ব, র্ধং, র্প্য, র্পঃ, র্ব্ভ, র্ভ্য, র্ভং, র্ম্য, র্মং, র্লং, র্ব্য, র্বং, র্শ্য, র্শ্ব, র্শঃ, র্ষ্ট, র্ষ্ণ, র্ষ্য, র্স্ট, র্স্য, র্সঃ, র্হঃ, ল্ক্য, ল্প্য, ব্যং, শ্চ্য, শ্বঃ, ষ্ক্র, ষ্ক্ব, ষ্ট্য, ষ্ট্র, ষ্টং, ষ্ঠ্য, ষ্ঠং, ষ্ণ্য, ষ্প্র, ষ্ম্য, স্ক্র, স্ট্র, স্টং, স্ত্য, স্ত্র, স্ত্ব, স্তঁ, স্থ্য, স্ন্য, স্প্র, স্প্ল, স্ফং, স্রং, স্বঃ, হ্ম্য = ১৬৮টি
চার বর্ণ:--
ক্ষ্ণ্য, ক্ষ্ম্য, ঙ্ক্ষ্য, ত্র্যং, দ্ব্যং, ন্ত্যং, ন্ত্র্য, ন্দ্রং, ন্ধ্যং, র্দ্ধ্ব, র্দ্ধং, র্ব্ভ্য, র্ষ্ণ্য, স্ট্রং, স্ত্রং, স্প্রং = ১৬টি
দুই বর্ণ=২১১, তিনবর্ণ=১৬৮, চার বর্ণ=১৬ সর্বমোট=২১১+১৬৮+১৬=৩৯৫টি
যুক্তধ্বনি আর যুক্তবর্ণ ঠিক এক জিনিস নয় যুক্তবর্ণ হলেই যে তা যুক্তধ্বনি হবে এমন নয়, তবে সকল যুক্তধ্বনিই যুক্তবর্ণ যেখানে ধ্বনি সান্দ্র তথা তা বিশ্লিষ্ট করে বলা, বা লেখা যাবে না সেটাই হল যুক্তধ্বনি, তথা সান্দ্রধ্বনি, তার তালিকা নীচে দেখানো হল:--
ক্ন, ক্র ক্ল খ্ম খ্র গ্র গ্ল ঘ্ন ঘ্র চ্চ জ্র ট্র ড্র ত্ত ত্র থ্র দ্র ধ্ধ ধ্ম ধ্র ন্র প্র প্ল ফ্র ফ্ল ব্ব ব্র ব্ল ভ্র ভ্ল ম্র ম্ল রর ল্র শ্ট শ্ট্র শ্ন শ্ল শ্শ স্ক স্ক্র স্খ স্ত স্ত্র স্থ স্ন স্প স্প্র স্প্ল স্ফ স্ম স্ম্র স্র স্ল হ্র হ্ল
= ৫৬টি
পাদ্রি জন মারডকের কথা কিছু বলা দরকার ইংরেজ পাদ্রি জন মারডক ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরকে বাংলা বানান সংস্কারের এক সুলিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন (Letter to Babu Iswarchandra Vidyasagar on Bengali typography.) তার দশ বছর আগে ১৮৫৫-তে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা [বিদ্যাসাগর] তাঁর বর্ণপরিচয় প্রকাশ করেন “বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা মুদ্রণ সহজতর করার জন্য ক্রিশ্চিয়ান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির এজেন্ট পাদ্রি জন মার্ডকের ভাবনা ও প্রযত্নের কথা এখানে উল্লেখ্য স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশনায় দীর্ঘকাল যুক্ত থেকে তিনি বাংলাভাষার প্রয়োগকৌশলগত যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হন তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে বাংলা অক্ষর সংস্কারের কয়েকটি প্রস্তাব করেন” (বাংলা মুদ্রণের চার যুগ-- বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন--আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ-১০০) মারডক তাঁর চিঠিতে বাংলাভাষার জন্য যে প্রস্তাব দেন তা বিদেশির নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা বাংলাভাষার জন্য এক দূরপ্রসারী গতিশীল উন্নয়ন প্রস্তাব যদিও সে প্রস্তাব অনুসারে সেকালে কোনও সংস্কারই করা হয়নি, তবু তা এযুগেও অস্বীকার করা যায় না, বরং এযুগে সে ধরনের প্রয়াসই যুক্তিশীল মানুষকে টানছে মারডক (Murdoch) জানতেন যে তাঁর এই প্রস্তাব হয়তো গ্রহণ করা হবে না, তাই তিনি এটাও বলেন যে, "Though the proposal may now be treated with ridicule(পরিহাস), its adoption is a mere question of time." (ঐ) প্রস্তাবটি অবশ্য সরাসরি বানান সংস্কারের দিকে লক্ষ করে করা না হলেও, বাংলা ভাষার লিখন ও ছাপাকে তা প্রভাবিত করবে, আরও হয়তো সময় লাগবে, তবে তা হবেই বাংলা লাইনো ছাপায় তা বহুল পরিমাণে গ্রহণ করা হয়েও ছিল, কিন্তু অতি আধুনিক ছাপার পিটিএস বা ডিটিপিতে এসে তা আবার ফিরে গেছে সেই নিজ নিকেতনে-- হাতে ছাপার কুক্ষিতে
বিদেশিরা আমাদের জন্য নানা বিষয়ে চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু আমরা তা সঠিকভাবে অনেক সময় গ্রহণ করতে পারিনি ফলে আমাদের অবস্থানে পরিবর্তন হয়নি, জড়তা কাটেনি বাংলা ছাপার দিকে একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে, নবাগত বা বিদেশির দৃষ্টি নিয়ে তাকালে, বাংলা ছাপার অসহায় বিস্রস্ত রূপটি চোখে পড়বে ছাপার খারাপ মানের কথা বলছি না, হরফ যোজনার বিকট চেহারা, হরফের উপরে হরফ, তার উপরে রেফ, আর এদিকে হরফের নীচে নানা চিহ্ন এছাড়া লিপির নিজস্ব হাত পা বিস্তার তো আছেই সেটা তো অমোঘ অপরিবর্তনীয়, বর্ণযোজনাকালে সেগুলি আবার নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে কী কাণ্ড! তবু আমরা চোখ বুঁজে থাকি স্বাবলম্বী হবার প্রয়াস তেমন চোখে পড়ে না
বাংলা ছাপার সূচনা, বিকাশ ও প্রসারে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড ও চার্লস উইলকিনস এই দুজন বিদেশি এবং তাঁদের সহযোগী একজন দেশি মানুষ পঞ্চানন কর্মকার স্মরণীয় হয়ে রইলেন একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে সামনে কোনও পূর্ব-উদাহরণ না থাকা সত্বেও পঞ্চানন অপূর্ব দক্ষতায় টাইপ নির্মাণ করেছিলেন একে শুধু নির্মাণ না বলে বলা উচিত সৃষ্টি ছাপাখানার টাইপ নির্মাণ পঞ্চাননের জীবিকা হয়ে উঠেছিল, এবং পঞ্চানন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন) এই প্রবাহ সঞ্চালন করে দিয়েছিলেন তাঁর জামাই মনোহর মিস্ত্রি, ও পরবর্তীতে মনোহরের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি মুদ্রণ শিল্পের এই দক্ষতার ধারা বজায় রেখেছিলেন পঞ্চাননের চেয়ে তাঁর জামাই মনোহর আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, এবং মনোহরের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র অতীব দক্ষতা অর্জন করেন কৃষ্ণচন্দ্র দীর্ঘজীবী হননি, তিনি কলেরায় মারা যান ১৮মে, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তখনও তাঁর মা এবং স্ত্রী বেঁচে “১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৮মে, শ্রীরামপুরে প্রায় তেতাল্লিশ বছর বয়সে নিঃসন্তান কৃষ্ণচন্দ্র বিসূচিকা রোগে পরলোক গমন করেন তখন তাঁর মাতা ও পত্নী উভয়েই জীবিত ছিলেন”(প্রবীর সরকার-- দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন, পৃঃ-৮৭)
শোনা যায় পঞ্চাননের একটি মূর্তি বসানো হয়েছে শ্রীরামপুরে, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বই প্রকাশ করা দরকার নয়তো নবযুগের সূচনাকারী আমাদের ক্যাক্সটন, গুটেনবার্গ অচেনার অন্ধকারে থেকে যাবেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ঘাটতি থেকে যাবে, যা আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করবে না
এঁদের পদবি দেখে মনে হয় এঁরা সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষ ছিলেন, তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও সামাজিক ভূমিকায় তাঁরা বাংলার মুদ্রণ তথা বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে যে অপরিমেয় অবদান রেখেছেন সেজন্য তাঁরা আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন, ভবিষ্যতেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন
আগে উল্লেখ করা হয়েছে ছাপার কালির সঙ্গে পবিত্র গঙ্গা জল মিশিয়ে ছাপা শুরু করাতে ধর্মীয় গোঁড়ামি কমেছিল এ ঘটনায় মনে হয় সে যুগে বিদেশি “ম্লেচ্ছরা” ছাপা নামক এই “অপবিত্র” কাজে নিম্নবর্গীয় মানুষ ছাড়া কাউকে পাননি তাঁদের সহায়তা করার জন্য কারণ দেশের মানুষ এই লাল মুখো সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষদের ঘৃণার চোখে দেখত, ভয়ও পেত, যদি তাঁদের ধর্মনাশ করে দেয়(একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি-- “কেরি ও টমাস নিতান্ত মর্মাহত হয়ে পড়লেন। প্রথমত এবং প্রধানত তাঁরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছেন”)
আমরা ইচ্ছে করলে-- দরকার=দর্কার, সরকার=সর্কার, উল্টা=উলটা, পাল্টা=পালটা, সবজি=সব্জি, কোন্টা=কোন্টা ইত্যাদি লিখতে পারি পারি কারণ এখানে যুক্তধ্বনি হয়নি, কিন্তু যেখানে যুক্তধ্বনি হবে সেখানে ইচ্ছে করলেও এভাবে লেখা যাবে না সেখানে যুক্তবর্ণ করেই লিখতে হবে যেমন-- “বিস্তর পুস্তক দোস্তকে সস্তায় গস্তায়” এখানে ইচ্ছে করলেই লেখা যাবে-- “বিস্তর পুস্তক দোস্তকে সস্তায় গস্তায়” আবার ইচ্ছে করলে, ‘বিসতর পুসতক দোসতকে সসতায় গসতায়’-- এভাবেও লেখা চলতে পারে এখানে যুক্তধ্বনি হয়নি বলেই এটা করা সম্ভব কিন্তু যুক্তধ্বনি হলে সেটা করা যাবে না যেমন-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” এখানে ইচ্ছে করলেও, “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ”, লেখা চলে না এখানে যুক্তধ্বনি হয়েছে বলেই এটা করা সম্ভব নয় এরকম অবিভাজ্য যুক্তধ্বনিকে বলা যাবে সান্দ্রধ্বনি
বাংলায় এমনি সান্দ্রধ্বনি আছে প্রায় ৫৬টি, সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তবে সেখানে যেভাবে এর উপস্থাপনা করা হয়েছে তা সবটা ঠিক চলতি রীতি নয় “বাংলা নতুন-বানান” কেমন হবে সে কথা আলোচনা করতে গিয়ে এগুলি সেখানে আলোচনা করা হয়েছে[দেখুন, http://banglamagna.blogspot.com/ ‘বাংলামগ্ন’ ব্লগ, ডিসেম্বর, ২০০৯, অংশে] তার কিছু হদিস এখানে দেখানো গেল তবে সান্দ্রধ্বনি বা যুক্তধ্বনিকে নতুন পুরানো কোনও অবস্থাতেই ভেঙে বা বিশ্লিষ্ট করে লেখা চলবে না
যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাঁরা জানেন, একটি হরফ লিখতে হলে একটি চাবি তথা ‘কি’(key) চাপতে হয় একটি চাবিতে একটি হরফের সংকেত থাকে আমরা লিখব “ক”, সেজন্য নির্দিষ্ট চাবি চাপলাম আবার ‘ক্’ লেখার সময়ে ক লিখে হস্ চিহ্নের জন্য অন্য আর একটি চাবি চাপলাম, তাই হল ‘ক্’ এই হস্ চিহ্ন ব্যবহার করলে বর্ণটির ধ্বনি হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত হয়, অর্থাৎ বর্ণটির ধ্বনি-সংক্ষেপ বোঝায় আমরা লিখতে পারি “শক্ত”, আবার লিখতে পারি “শক্ত” ‘শক্ত’ লেখার সময়ে আমরা কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ত’ দুটি বর্ণ মিলে একত্র হয়ে যাবে না আবার ‘শক্ত’ লেখার সময়ে কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ত’ দুটি বর্ণ মিলে একটি যুক্তবর্ণ হবে কম্পিউটার সেই মতো সব কিছু করবে আবার আমরা ‘ক’ আর ‘ষ’ মিলিয়ে ক্ষ করার সময়ে কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ষ’ দুটি বর্ণ মিলে একটি যুক্তবর্ণ হবে, আর তার রূপ করতে চাই একটি হরফমণ্ড তখন সফ্টওয়্যারে এমন সংকেত দেওয়া থাকে যে দুটি মিলে “ক্ষ” না হয়ে তা হরফমণ্ড “ক্ষ” দেখাবে যদি তা সাধারণভাবে “ক্ষ” হত, তবে তখন সফ্টওয়্যারে জটিলতা কিছুটা কম হত সুতরাং হাতে করে লেখার কালে আমাদের যেমন মনে রাখতে হয় যে-- ক+ষ=ক্ষ হবে, তেমনি কম্পিউটারে লিখবার সময়ে কম্পিউটারকেও সে কথা মনে রাখাতে হয়, নইলে তা হবে ‘ক্ষ’ এসব করতে জটিলতা বাড়ে তা কেবল যে হরফের চেহারায় জটিলতা তা-ই নয়, কম্পিউটার সফ্টওয়্যারেও জটিলতা এসব হল কম্পিউটারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারএ ধরনের অকারণ জটিলতা কমে যাবে যুক্তবর্ণ সরল করে লিখলে, যাকে বলা হয়েছে ‘স্বচ্ছ যুক্তবর্ণ’
আগে সব কিছু সাহিত্য ছিল পদ্যে বা কবিতায় রচিত গদ্য ছিল না পরে ইংরেজ আমলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে বলা চলে বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উদ্ভব বলতে যদি সংকোচ হয়, বিকাশ যে হয়েছিল সে কথা না মানার কোনওই অর্থ নেই
বিদেশিরা আমাদের ছাপাখানার সৃষ্টি করেছে, বিদেশিরা আমাদের গদ্যের বিকাশ ঘটিয়েছে আমরা এতটা বিদেশি নির্ভর হয়ে আর কতকাল থাকব? তাও বিদেশি পাদ্রি জন মারডক বাংলা যুক্তবর্ণের লজিক্যাল বিন্যাস করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমরা সেটা নেইনি এখন অন্তত সেটা নতুন করে বিবেচনা করা দরকার জন মারডক প্রস্তাবিত পদ্ধতি ঠিক সেভাবে যদি নাও গ্রহণ করি, তার সংশোধিত রূপ আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এটা অবধারিত
উপরে যে বাংলা যুক্তবর্ণের সংশোধিত রূপ দেখানো হয়েছে, সে ব্যাপারটি জ্ঞানচারী সুধীজনেরা বিবেচনা করে দেখুন অন্তত কিছু উদ্যোগ নিতেই হবে আর আলুথালু বিস্রস্ত অবস্থায় বসে থাকার অর্থ হল অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়া সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সর্বশিখরে নিয়ে গেছেন, সে তো শতক পেরিয়ে গেছে, আর কতকাল তা ভাঙিয়ে চলবে? এবার পরবর্তী উদ্যোগ না নিলে বিপদ যে সামনে কথায় বলে ‘কোন্ কালে খেয়েছি ঘি, আর একটু আঙুল শুঁকে নি!’ কতকাল আমাদের আর ঘিয়ের গন্ধ শোঁকা চলতে থাকবে
কোনও দিন কি-- “সতরে সতরে সতমভিত মেঘসতূপ” লিখে পড়া এবং বোঝা যাবে-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” ইংরেজিতে তো হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে একাজ করা যায়, বাংলায় কবে তা করা যাবে? বাংলায় এভাবে করা বা পড়ার প্রধান বাধা এই যে, বাংলা বর্ণমালা ইংরেজির মতো পুরোপুরি এ্যালফাবেটিক(alphabetic) নয়, কিয়দংশে তা সিলাবিকও(syllabic) বটে ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি হরফের সঙ্গে একটি করে সহজাত(inherent) “অ” ধ্বনি সংযুক্ত থাকে তাই ‘ক’ কেবল ‘ক’ নয়, তা আসলে ক্+অ ব্যঞ্জনবর্ণ বা ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করা কঠিন, তাই প্রতিটি বর্ণের সঙ্গে একটি করে অন্তর্নিহিত “অ” আছে তাই তা সরাসরি ক খ গ ঘ এমনিভাবে পড়া বা উচ্চারণ করা যায় ইংরেজিতে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের এই সংকট এড়ানো হয়েছে প্রতিটি ব্যঞ্জনের একটি করে পৃথক নামকরণ করে তাই, b=bi:(বি), c=si:(সি), d=di:(ডি), f=ef(এফ) ইত্যাদি ফলে ইংরেজি বর্ণমালা নিখুঁত এ্যালফাবেটিক হতে পেরেছে, বাংলা তা হতে পারেনি বাংলা এখনও মাঝপথে দুয়ের মাঝখানে রয়ে গেছে-- না তা পুরো সিলাবিক(syllabic), না পুরো এ্যালফাবেটিক(alphabetic) যেদিন বাংলা বর্ণমালা সম্পূর্ণরূপে এ্যালফাবেটিক হয়ে উঠবে সেদিন “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” অনায়াসে লেখা যাবে-- “সতরে সতরে সতমভিত মেঘসতূপ” কিন্তু পড়া হবে-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” তখন ব্যঞ্জনবর্ণে সহজাত অ-ধ্বনি সক্রিয় না থাকায় হয়তো প্রয়োজনীয় স্থলে কখনও কখনও অ-এর(৹) চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে অ-এর জন্য বহিঃচিহ্ন হবে, অ=৹
যেমন--
অম৹ল=যা ম্লান নয়, নাম অমল৹= টক
কম৹ল=পদ্ম, কমল৹=কমিল
সর৹ল=সহজ, সরল৹=সরে গেল
ইত্যাদি
বাংলায় স্বরবর্ণ আছে ১১টি, এর ১০টির স্বরচিহ্ন বা কারচিহ্ন আছে যেমন-- া ি ী ু ূ ৃ ে ৈ ো ৌ, কেবল অ-এর কোনও স্বরচিহ্ন নেই আসলে আছে, তবে দৃশ্যত বা বাহ্য কোনও চিহ্ন নেই এই বাহ্যত না থাকাই তার উপস্থিতি প্রমাণ করছে প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে সেটি সংপৃক্ত হয়ে আছে অ-ধ্বনি, তথা অদৃশ্য ও অলক্ষ্য অ-চিহ্ন প্রতিটি ব্যঞ্জনের সহজাত অ-চিহ্ন অদৃশ্য বলে বাংলা লেখায় জটিলতা সেকারণে আর বাড়েনি, নয়তো বাংলা লেখা আরও যে কতই জটিল হত! বাংলা বর্ণমালাকে অ-এর সাহজাত্য(inherence) থেকে বের করে এনে অ-কে বহিঃচিহ্ন হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে কখনও কখনও(সব সময়ে নয়) তখন বাংলার আর হয়তো সত্যিই কোনও পিছুটান থাকবে না
ইংরেজিতে স্বরবর্ণ ছাড়া কোনও শব্দ হয়না, বাংলায়ও তা-ই কিন্তু গমন, চলন, গরজ, কথন, সহজ, গরম ইত্যাদি শব্দে স্বরবর্ণ বা স্বরচিহ্ন কোথায়? আছে স্বরবর্ণ অ বা অ-ধ্বনি এর প্রতিটি হরফে হরফে, সকলের সঙ্গে ওতপ্রোত বা সহজাত তাই অ-এর সাহজাত্য বর্জিত অবস্থা যে ঠিক কেমন হবে তা এই মুহূর্তে অনুমান করা একটু কঠিন
[Windows7, এবং Office Word7 environment-এ পড়লে সবটা ঠিক ঠিক পড়া যাবে
ফন্ট-- অহনলিপি-বাংলা১৪(AhanLipi-Bangla14)]
===
ঋণ:
বহু গ্রন্থ, পত্র পত্রিকা, অভিধান থেকে নানাভাবে সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে তাঁদের সকলের কাছে মুক্তকণ্ঠে ঋণ স্বীকার করি ও প্রণতি জানাই
১৭/০৯/২০১০
(২)c1c1C2 -- ন্+দ+র=ন্দ্র → চন্দ্র, স্+প্+ল → স্প্ল → স্প্লেনডিড, স্প্লিট
এই রীতিতে চলতি অভ্যাসে বেশ কিছুটা ধাক্কা লাগবে, কিন্তু দলাপাকানো হরফের চেয়ে তা অনেক সহজ হবে মণ্ড হরফের জটিলতা এতে অপসারিত হয়ে তা সহজবোধ্য হবে
এই রীতির একটা বড় সুবিধা হল এই যে যাঁরা বাংলা কম্পিউটার ফন্ট নির্মাণ করতে চান তাঁরা অনেক সহজে সকল যুক্তবর্ণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন ভবিষ্যতে যদি অন্য ভাষা থেকে আগত ধ্বনির জন্য নতুন নতুন যুক্তবর্ণ লিখতে হয় তবুও তা সহজে লেখা যাবে, ফন্ট সফ্টওয়্যার সংশোধন করতে হবেনা দলা পাকানো হরফমণ্ড তৈরি করতে হবে না কারণ এই রীতির পরিসর সুদূর বিস্তৃত, সেখানে বিচরণ করা যাবে অবাধে ফন্ট সফ্টওয়্যার হবে অনেক কম আয়তনের, এবং নির্মিতিতে অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ, সরল দেখা যাচ্ছে চলতি বাংলা ইউনিকোড ফন্টে যেখানে মণ্ড যুক্তবর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি ৩ থেকে ৬গুণ বেশি বড় হয় এই উদ্দিষ্ট ফন্টের আয়তন ৮৮ কেবি, আর অন্য ফন্টের আয়তন ২২৭ কেবি থেকে ৪৭৮ কেবি, বা কিছু কমবেশি
দেখা যাক বাংলা যুক্তবর্ণ কেমন গঠনের হবে--
দুই বর্ণ:--
ক্ক, ক্ট, ক্ত, ক্ন, ক্ম, ক্য, ক্র, ক্ল, ক্ব, ক্ষ, ক্স, খ্ম, খ্য, ক্র, গ্দ, গ্ধ, গ্ন, গ্ম, গ্য, গ্র, গ্ল, গ্ব, ঘ্ন, ঘ্য, গ্র, ঘ্ব, ঙ্ক, ঙ্খ, ঙ্গ, ঙ্ঘ, ঙ্ম, চ্চ, চ্ছ, চ্ঞ, চ্য, ছ্য, জ্জ, জ্ঝ, জ্ঞ, জ্য, জ্র, জ্ব, ঞ্চ, ঞ্ছ, ঞ্জ, ঞ্ঝ, ঞ্য, ট্ট, ট্ম, ট্য, ট্র, ট্ব, ঠ্ব, ড্ড, ড্ম, ড্য, ড্র, ড্ব, ফ্য, ঢ্র, ণ্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ঢ, ণ্ণ, ণ্ম, ণ্য, ণ্ব, ত্ত, ত্থ, ত্ন, ত্ম, ত্য, ত্র, ত্ব, থ্য, থ্র, থ্ব, দ্গ, দ্ঘ, দ্দ, দ্ধ, দ্ভ, দ্ম, দ্য, দ্য, দ্র, দ্ব, ধ্ন, ধ্ম, ধ্য, ধ্র, ধ্ব, ন্ট, ন্ড, ন্ত, ন্থ, ন্দ, ন্ধ, ন্ন, ন্ম, ন্য, ন্ব, ন্স, প্ট, প্ত, প্ন, প্প, প্য, প্র, প্ল, প্স, ফ্র, ফ্ল, ব্জ, ব্দ, ব্ধ, ব্ব, ব্ল, ভ্য, ভ্র, ভ্ল, ম্ন, ম্প, ম্ফ, ম্ব, ম্ভ, ম্ম, ম্য, ম্র, ম্ল, য্য, ঋর্, র্ক, র্খ, র্গ, র্ঘ, র্চ, র্ছ, র্জ, র্ঝ, র্ট, র্ড, র্ণ, র্ত, র্থ, র্দ, র্ধ, র্ন, র্প, র্ফ, র্ভ, র্ম, র্য, র্র, র্ল, র্ব, র্শ, র্ষ, র্স, র্হ, ৎর্ , ল্ক, ল্গ, ল্ট, ল্ড, ল্প, ল্ফ, ল্ম, ল্য, ল্ল, ল্ব, ব্য, ব্র, শ্চ, শ্ছ, শ্ন, শ্ম, শ্য, শ্র, শ্ল, শ্ব, ষ্ক, ষ্ট, ষ্ঠ, ষ্ণ, ষ্প, ষ্ফ, ষ্ম, ষ্য, ষ্ব, স্ক, স্খ, স্ট, স্ত, স্থ, স্ন, স্প, স্ফ, স্ম, স্য, স্র, স্ল, স্ব, হ্ণ, হ্ন, হ্ম, হ্য, হ্র, হ্ল, হ্ব, ড়্গ = ২১১টি
এখানে দ্য এবং ঋর্ -- এই দুটি গণনা থেকে বাদ, কারণ দ্য [দ+য=দ্য]একবার গণনা করা হয়েছে ঋর্ যুক্ত বর্ণ নয়, কারণ এখানে স্বরবর্ণে ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হয়েছে র+ঋ → র্+ঋ → র্ +ঋ=ঋর্ যেমন কা, কৃ, কো এগুলি যুক্তবর্ণ নয় বিভ্রান্তি হবার কারণ হল র-বর্ণটি রেফ চিহ্ন হয়ে ঋ-এর উপরে বসেছে
তিন বর্ণ:--
ক্ট্র, ক্ত্য, ক্ত্র, ক্ন্য, ক্যং, ক্রং, ক্ল্য, ক্ষ্ণ, ক্ষ্ম, ক্ষ্য, ক্ষ্ব, ক্ষং, ক্ষঃ, ক্ষঁ, গ্ধ্য, গ্ন্য, গ্নং, গ্র্য, ঘ্ন্য, ঙ্ক্য, ঙ্ক্র, ঙ্ক্ষ, ঙ্খ্য, ঙ্গ্য, ঙ্গঃ, ঙ্ঘ্য, ঙ্ঘ্র, ঙ্ঘঃ, চ্চঃ, চ্ছ্র, চ্ছ্ব, জ্জ্ব, ণ্ঠ্য, ণ্ড্য, ণ্ড্র, ত্ত্য, ত্ত্র, ত্ত্ব, ত্ন্য, ত্ম্য, ত্যং, ত্র্য, ত্রং, দ্দ্য, দ্দ্ব, দ্দং, দ্ধ্য, দ্ধ্র, দ্ধ্ব, দ্ভ্র, দ্যঃ, দ্র্য, দ্রং, দ্ব্য, দ্বং, ধ্বং, ন্ট্র, ন্টং, ন্ড্র, ন্ত্য, ন্ত্র, ন্ত্ব, ন্তঃ, ন্দ্য, ন্দ্র, ন্দ্ব, ন্দং, ন্দঃ, ন্ধ্য, ন্ধ্র, ন্ধঃ, ন্ন্য, প্ত্র, প্রং, ফ্রঁ, ব্ধ্য, ব্ধ্র, ব্বঃ, ব্ভ্র, ব্রঁ, ব্ল্য, ভ্যং, ভ্রং, ম্প্য, ম্প্র, ম্পং, ম্ব্র, ম্ভ্র, ম্ভঃ, র্ক্ত, র্ক্য, র্গ্য, র্গ্র, র্ঘ্য, র্ঙ্গ, র্চ্ছ, র্চ্য, র্চঃ, র্জ্ঞ, র্জ্য, র্জঃ, র্ট্র, র্ঢ্য, র্ণ্য, র্ণঃ, র্ত্ম, র্ত্য, র্ত্র, র্থ্য, র্থং, র্দ্ধ, র্দ্য, র্দ্র, র্দ্ব, র্দঃ, র্ধ্য, র্ধ্ব, র্ধং, র্প্য, র্পঃ, র্ব্ভ, র্ভ্য, র্ভং, র্ম্য, র্মং, র্লং, র্ব্য, র্বং, র্শ্য, র্শ্ব, র্শঃ, র্ষ্ট, র্ষ্ণ, র্ষ্য, র্স্ট, র্স্য, র্সঃ, র্হঃ, ল্ক্য, ল্প্য, ব্যং, শ্চ্য, শ্বঃ, ষ্ক্র, ষ্ক্ব, ষ্ট্য, ষ্ট্র, ষ্টং, ষ্ঠ্য, ষ্ঠং, ষ্ণ্য, ষ্প্র, ষ্ম্য, স্ক্র, স্ট্র, স্টং, স্ত্য, স্ত্র, স্ত্ব, স্তঁ, স্থ্য, স্ন্য, স্প্র, স্প্ল, স্ফং, স্রং, স্বঃ, হ্ম্য = ১৬৮টি
চার বর্ণ:--
ক্ষ্ণ্য, ক্ষ্ম্য, ঙ্ক্ষ্য, ত্র্যং, দ্ব্যং, ন্ত্যং, ন্ত্র্য, ন্দ্রং, ন্ধ্যং, র্দ্ধ্ব, র্দ্ধং, র্ব্ভ্য, র্ষ্ণ্য, স্ট্রং, স্ত্রং, স্প্রং = ১৬টি
দুই বর্ণ=২১১, তিনবর্ণ=১৬৮, চার বর্ণ=১৬ সর্বমোট=২১১+১৬৮+১৬=৩৯৫টি
যুক্তধ্বনি আর যুক্তবর্ণ ঠিক এক জিনিস নয় যুক্তবর্ণ হলেই যে তা যুক্তধ্বনি হবে এমন নয়, তবে সকল যুক্তধ্বনিই যুক্তবর্ণ যেখানে ধ্বনি সান্দ্র তথা তা বিশ্লিষ্ট করে বলা, বা লেখা যাবে না সেটাই হল যুক্তধ্বনি, তথা সান্দ্রধ্বনি, তার তালিকা নীচে দেখানো হল:--
ক্ন, ক্র ক্ল খ্ম খ্র গ্র গ্ল ঘ্ন ঘ্র চ্চ জ্র ট্র ড্র ত্ত ত্র থ্র দ্র ধ্ধ ধ্ম ধ্র ন্র প্র প্ল ফ্র ফ্ল ব্ব ব্র ব্ল ভ্র ভ্ল ম্র ম্ল রর ল্র শ্ট শ্ট্র শ্ন শ্ল শ্শ স্ক স্ক্র স্খ স্ত স্ত্র স্থ স্ন স্প স্প্র স্প্ল স্ফ স্ম স্ম্র স্র স্ল হ্র হ্ল
= ৫৬টি
পাদ্রি জন মারডকের কথা কিছু বলা দরকার ইংরেজ পাদ্রি জন মারডক ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরকে বাংলা বানান সংস্কারের এক সুলিখিত প্রস্তাব দিয়েছিলেন (Letter to Babu Iswarchandra Vidyasagar on Bengali typography.) তার দশ বছর আগে ১৮৫৫-তে ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা [বিদ্যাসাগর] তাঁর বর্ণপরিচয় প্রকাশ করেন “বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা মুদ্রণ সহজতর করার জন্য ক্রিশ্চিয়ান ভার্নাকুলার এডুকেশন সোসাইটির এজেন্ট পাদ্রি জন মার্ডকের ভাবনা ও প্রযত্নের কথা এখানে উল্লেখ্য স্কুলপাঠ্য বই প্রকাশনায় দীর্ঘকাল যুক্ত থেকে তিনি বাংলাভাষার প্রয়োগকৌশলগত যে সব অসুবিধার সম্মুখীন হন তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি বিদ্যাসাগরকে লেখা একটি খোলা চিঠিতে বাংলা অক্ষর সংস্কারের কয়েকটি প্রস্তাব করেন” (বাংলা মুদ্রণের চার যুগ-- বরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন--আনন্দ পাবলিশার্স, কোলকাতা, পৃঃ-১০০) মারডক তাঁর চিঠিতে বাংলাভাষার জন্য যে প্রস্তাব দেন তা বিদেশির নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখা বাংলাভাষার জন্য এক দূরপ্রসারী গতিশীল উন্নয়ন প্রস্তাব যদিও সে প্রস্তাব অনুসারে সেকালে কোনও সংস্কারই করা হয়নি, তবু তা এযুগেও অস্বীকার করা যায় না, বরং এযুগে সে ধরনের প্রয়াসই যুক্তিশীল মানুষকে টানছে মারডক (Murdoch) জানতেন যে তাঁর এই প্রস্তাব হয়তো গ্রহণ করা হবে না, তাই তিনি এটাও বলেন যে, "Though the proposal may now be treated with ridicule(পরিহাস), its adoption is a mere question of time." (ঐ) প্রস্তাবটি অবশ্য সরাসরি বানান সংস্কারের দিকে লক্ষ করে করা না হলেও, বাংলা ভাষার লিখন ও ছাপাকে তা প্রভাবিত করবে, আরও হয়তো সময় লাগবে, তবে তা হবেই বাংলা লাইনো ছাপায় তা বহুল পরিমাণে গ্রহণ করা হয়েও ছিল, কিন্তু অতি আধুনিক ছাপার পিটিএস বা ডিটিপিতে এসে তা আবার ফিরে গেছে সেই নিজ নিকেতনে-- হাতে ছাপার কুক্ষিতে
বিদেশিরা আমাদের জন্য নানা বিষয়ে চেষ্টা করে গেছেন, কিন্তু আমরা তা সঠিকভাবে অনেক সময় গ্রহণ করতে পারিনি ফলে আমাদের অবস্থানে পরিবর্তন হয়নি, জড়তা কাটেনি বাংলা ছাপার দিকে একটু নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকালে, নবাগত বা বিদেশির দৃষ্টি নিয়ে তাকালে, বাংলা ছাপার অসহায় বিস্রস্ত রূপটি চোখে পড়বে ছাপার খারাপ মানের কথা বলছি না, হরফ যোজনার বিকট চেহারা, হরফের উপরে হরফ, তার উপরে রেফ, আর এদিকে হরফের নীচে নানা চিহ্ন এছাড়া লিপির নিজস্ব হাত পা বিস্তার তো আছেই সেটা তো অমোঘ অপরিবর্তনীয়, বর্ণযোজনাকালে সেগুলি আবার নিজেদের মধ্যে জড়াজড়ি করে কী কাণ্ড! তবু আমরা চোখ বুঁজে থাকি স্বাবলম্বী হবার প্রয়াস তেমন চোখে পড়ে না
বাংলা ছাপার সূচনা, বিকাশ ও প্রসারে ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড ও চার্লস উইলকিনস এই দুজন বিদেশি এবং তাঁদের সহযোগী একজন দেশি মানুষ পঞ্চানন কর্মকার স্মরণীয় হয়ে রইলেন একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে সামনে কোনও পূর্ব-উদাহরণ না থাকা সত্বেও পঞ্চানন অপূর্ব দক্ষতায় টাইপ নির্মাণ করেছিলেন একে শুধু নির্মাণ না বলে বলা উচিত সৃষ্টি ছাপাখানার টাইপ নির্মাণ পঞ্চাননের জীবিকা হয়ে উঠেছিল, এবং পঞ্চানন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন) এই প্রবাহ সঞ্চালন করে দিয়েছিলেন তাঁর জামাই মনোহর মিস্ত্রি, ও পরবর্তীতে মনোহরের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র মিস্ত্রি মুদ্রণ শিল্পের এই দক্ষতার ধারা বজায় রেখেছিলেন পঞ্চাননের চেয়ে তাঁর জামাই মনোহর আরও বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, এবং মনোহরের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র অতীব দক্ষতা অর্জন করেন কৃষ্ণচন্দ্র দীর্ঘজীবী হননি, তিনি কলেরায় মারা যান ১৮মে, ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তখনও তাঁর মা এবং স্ত্রী বেঁচে “১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৮মে, শ্রীরামপুরে প্রায় তেতাল্লিশ বছর বয়সে নিঃসন্তান কৃষ্ণচন্দ্র বিসূচিকা রোগে পরলোক গমন করেন তখন তাঁর মাতা ও পত্নী উভয়েই জীবিত ছিলেন”(প্রবীর সরকার-- দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন, পৃঃ-৮৭)
শোনা যায় পঞ্চাননের একটি মূর্তি বসানো হয়েছে শ্রীরামপুরে, কিন্তু তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বই প্রকাশ করা দরকার নয়তো নবযুগের সূচনাকারী আমাদের ক্যাক্সটন, গুটেনবার্গ অচেনার অন্ধকারে থেকে যাবেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ঘাটতি থেকে যাবে, যা আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করবে না
এঁদের পদবি দেখে মনে হয় এঁরা সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গীয় মানুষ ছিলেন, তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও সামাজিক ভূমিকায় তাঁরা বাংলার মুদ্রণ তথা বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে যে অপরিমেয় অবদান রেখেছেন সেজন্য তাঁরা আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন, ভবিষ্যতেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন
আগে উল্লেখ করা হয়েছে ছাপার কালির সঙ্গে পবিত্র গঙ্গা জল মিশিয়ে ছাপা শুরু করাতে ধর্মীয় গোঁড়ামি কমেছিল এ ঘটনায় মনে হয় সে যুগে বিদেশি “ম্লেচ্ছরা” ছাপা নামক এই “অপবিত্র” কাজে নিম্নবর্গীয় মানুষ ছাড়া কাউকে পাননি তাঁদের সহায়তা করার জন্য কারণ দেশের মানুষ এই লাল মুখো সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষদের ঘৃণার চোখে দেখত, ভয়ও পেত, যদি তাঁদের ধর্মনাশ করে দেয়(একটি প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি-- “কেরি ও টমাস নিতান্ত মর্মাহত হয়ে পড়লেন। প্রথমত এবং প্রধানত তাঁরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছেন”)
আমরা ইচ্ছে করলে-- দরকার=দর্কার, সরকার=সর্কার, উল্টা=উলটা, পাল্টা=পালটা, সবজি=সব্জি, কোন্টা=কোন্টা ইত্যাদি লিখতে পারি পারি কারণ এখানে যুক্তধ্বনি হয়নি, কিন্তু যেখানে যুক্তধ্বনি হবে সেখানে ইচ্ছে করলেও এভাবে লেখা যাবে না সেখানে যুক্তবর্ণ করেই লিখতে হবে যেমন-- “বিস্তর পুস্তক দোস্তকে সস্তায় গস্তায়” এখানে ইচ্ছে করলেই লেখা যাবে-- “বিস্তর পুস্তক দোস্তকে সস্তায় গস্তায়” আবার ইচ্ছে করলে, ‘বিসতর পুসতক দোসতকে সসতায় গসতায়’-- এভাবেও লেখা চলতে পারে এখানে যুক্তধ্বনি হয়নি বলেই এটা করা সম্ভব কিন্তু যুক্তধ্বনি হলে সেটা করা যাবে না যেমন-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” এখানে ইচ্ছে করলেও, “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ”, লেখা চলে না এখানে যুক্তধ্বনি হয়েছে বলেই এটা করা সম্ভব নয় এরকম অবিভাজ্য যুক্তধ্বনিকে বলা যাবে সান্দ্রধ্বনি
বাংলায় এমনি সান্দ্রধ্বনি আছে প্রায় ৫৬টি, সেকথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে তবে সেখানে যেভাবে এর উপস্থাপনা করা হয়েছে তা সবটা ঠিক চলতি রীতি নয় “বাংলা নতুন-বানান” কেমন হবে সে কথা আলোচনা করতে গিয়ে এগুলি সেখানে আলোচনা করা হয়েছে[দেখুন, http://banglamagna.blogspot.com/ ‘বাংলামগ্ন’ ব্লগ, ডিসেম্বর, ২০০৯, অংশে] তার কিছু হদিস এখানে দেখানো গেল তবে সান্দ্রধ্বনি বা যুক্তধ্বনিকে নতুন পুরানো কোনও অবস্থাতেই ভেঙে বা বিশ্লিষ্ট করে লেখা চলবে না
যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন তাঁরা জানেন, একটি হরফ লিখতে হলে একটি চাবি তথা ‘কি’(key) চাপতে হয় একটি চাবিতে একটি হরফের সংকেত থাকে আমরা লিখব “ক”, সেজন্য নির্দিষ্ট চাবি চাপলাম আবার ‘ক্’ লেখার সময়ে ক লিখে হস্ চিহ্নের জন্য অন্য আর একটি চাবি চাপলাম, তাই হল ‘ক্’ এই হস্ চিহ্ন ব্যবহার করলে বর্ণটির ধ্বনি হলন্ত বা ব্যঞ্জনান্ত হয়, অর্থাৎ বর্ণটির ধ্বনি-সংক্ষেপ বোঝায় আমরা লিখতে পারি “শক্ত”, আবার লিখতে পারি “শক্ত” ‘শক্ত’ লেখার সময়ে আমরা কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ত’ দুটি বর্ণ মিলে একত্র হয়ে যাবে না আবার ‘শক্ত’ লেখার সময়ে কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ত’ দুটি বর্ণ মিলে একটি যুক্তবর্ণ হবে কম্পিউটার সেই মতো সব কিছু করবে আবার আমরা ‘ক’ আর ‘ষ’ মিলিয়ে ক্ষ করার সময়ে কম্পিউটারকে সংকেত দিলাম যে ‘ক’ আর ‘ষ’ দুটি বর্ণ মিলে একটি যুক্তবর্ণ হবে, আর তার রূপ করতে চাই একটি হরফমণ্ড তখন সফ্টওয়্যারে এমন সংকেত দেওয়া থাকে যে দুটি মিলে “ক্ষ” না হয়ে তা হরফমণ্ড “ক্ষ” দেখাবে যদি তা সাধারণভাবে “ক্ষ” হত, তবে তখন সফ্টওয়্যারে জটিলতা কিছুটা কম হত সুতরাং হাতে করে লেখার কালে আমাদের যেমন মনে রাখতে হয় যে-- ক+ষ=ক্ষ হবে, তেমনি কম্পিউটারে লিখবার সময়ে কম্পিউটারকেও সে কথা মনে রাখাতে হয়, নইলে তা হবে ‘ক্ষ’ এসব করতে জটিলতা বাড়ে তা কেবল যে হরফের চেহারায় জটিলতা তা-ই নয়, কম্পিউটার সফ্টওয়্যারেও জটিলতা এসব হল কম্পিউটারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারএ ধরনের অকারণ জটিলতা কমে যাবে যুক্তবর্ণ সরল করে লিখলে, যাকে বলা হয়েছে ‘স্বচ্ছ যুক্তবর্ণ’
আগে সব কিছু সাহিত্য ছিল পদ্যে বা কবিতায় রচিত গদ্য ছিল না পরে ইংরেজ আমলে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে বলা চলে বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে উদ্ভব বলতে যদি সংকোচ হয়, বিকাশ যে হয়েছিল সে কথা না মানার কোনওই অর্থ নেই
বিদেশিরা আমাদের ছাপাখানার সৃষ্টি করেছে, বিদেশিরা আমাদের গদ্যের বিকাশ ঘটিয়েছে আমরা এতটা বিদেশি নির্ভর হয়ে আর কতকাল থাকব? তাও বিদেশি পাদ্রি জন মারডক বাংলা যুক্তবর্ণের লজিক্যাল বিন্যাস করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, আমরা সেটা নেইনি এখন অন্তত সেটা নতুন করে বিবেচনা করা দরকার জন মারডক প্রস্তাবিত পদ্ধতি ঠিক সেভাবে যদি নাও গ্রহণ করি, তার সংশোধিত রূপ আমাদের অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে এটা অবধারিত
উপরে যে বাংলা যুক্তবর্ণের সংশোধিত রূপ দেখানো হয়েছে, সে ব্যাপারটি জ্ঞানচারী সুধীজনেরা বিবেচনা করে দেখুন অন্তত কিছু উদ্যোগ নিতেই হবে আর আলুথালু বিস্রস্ত অবস্থায় বসে থাকার অর্থ হল অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়া সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সর্বশিখরে নিয়ে গেছেন, সে তো শতক পেরিয়ে গেছে, আর কতকাল তা ভাঙিয়ে চলবে? এবার পরবর্তী উদ্যোগ না নিলে বিপদ যে সামনে কথায় বলে ‘কোন্ কালে খেয়েছি ঘি, আর একটু আঙুল শুঁকে নি!’ কতকাল আমাদের আর ঘিয়ের গন্ধ শোঁকা চলতে থাকবে
কোনও দিন কি-- “সতরে সতরে সতমভিত মেঘসতূপ” লিখে পড়া এবং বোঝা যাবে-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” ইংরেজিতে তো হরফ কেবলমাত্র পাশাপাশি বসিয়ে একাজ করা যায়, বাংলায় কবে তা করা যাবে? বাংলায় এভাবে করা বা পড়ার প্রধান বাধা এই যে, বাংলা বর্ণমালা ইংরেজির মতো পুরোপুরি এ্যালফাবেটিক(alphabetic) নয়, কিয়দংশে তা সিলাবিকও(syllabic) বটে ব্যঞ্জনবর্ণের প্রতিটি হরফের সঙ্গে একটি করে সহজাত(inherent) “অ” ধ্বনি সংযুক্ত থাকে তাই ‘ক’ কেবল ‘ক’ নয়, তা আসলে ক্+অ ব্যঞ্জনবর্ণ বা ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণ করা কঠিন, তাই প্রতিটি বর্ণের সঙ্গে একটি করে অন্তর্নিহিত “অ” আছে তাই তা সরাসরি ক খ গ ঘ এমনিভাবে পড়া বা উচ্চারণ করা যায় ইংরেজিতে ব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণের এই সংকট এড়ানো হয়েছে প্রতিটি ব্যঞ্জনের একটি করে পৃথক নামকরণ করে তাই, b=bi:(বি), c=si:(সি), d=di:(ডি), f=ef(এফ) ইত্যাদি ফলে ইংরেজি বর্ণমালা নিখুঁত এ্যালফাবেটিক হতে পেরেছে, বাংলা তা হতে পারেনি বাংলা এখনও মাঝপথে দুয়ের মাঝখানে রয়ে গেছে-- না তা পুরো সিলাবিক(syllabic), না পুরো এ্যালফাবেটিক(alphabetic) যেদিন বাংলা বর্ণমালা সম্পূর্ণরূপে এ্যালফাবেটিক হয়ে উঠবে সেদিন “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” অনায়াসে লেখা যাবে-- “সতরে সতরে সতমভিত মেঘসতূপ” কিন্তু পড়া হবে-- “স্তরে স্তরে স্তম্ভিত মেঘস্তূপ” তখন ব্যঞ্জনবর্ণে সহজাত অ-ধ্বনি সক্রিয় না থাকায় হয়তো প্রয়োজনীয় স্থলে কখনও কখনও অ-এর(৹) চিহ্ন ব্যবহার করতে হবে অ-এর জন্য বহিঃচিহ্ন হবে, অ=৹
যেমন--
অম৹ল=যা ম্লান নয়, নাম অমল৹= টক
কম৹ল=পদ্ম, কমল৹=কমিল
সর৹ল=সহজ, সরল৹=সরে গেল
ইত্যাদি
বাংলায় স্বরবর্ণ আছে ১১টি, এর ১০টির স্বরচিহ্ন বা কারচিহ্ন আছে যেমন-- া ি ী ু ূ ৃ ে ৈ ো ৌ, কেবল অ-এর কোনও স্বরচিহ্ন নেই আসলে আছে, তবে দৃশ্যত বা বাহ্য কোনও চিহ্ন নেই এই বাহ্যত না থাকাই তার উপস্থিতি প্রমাণ করছে প্রতিটি ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে সেটি সংপৃক্ত হয়ে আছে অ-ধ্বনি, তথা অদৃশ্য ও অলক্ষ্য অ-চিহ্ন প্রতিটি ব্যঞ্জনের সহজাত অ-চিহ্ন অদৃশ্য বলে বাংলা লেখায় জটিলতা সেকারণে আর বাড়েনি, নয়তো বাংলা লেখা আরও যে কতই জটিল হত! বাংলা বর্ণমালাকে অ-এর সাহজাত্য(inherence) থেকে বের করে এনে অ-কে বহিঃচিহ্ন হিসেবে প্রয়োগ করতে হবে কখনও কখনও(সব সময়ে নয়) তখন বাংলার আর হয়তো সত্যিই কোনও পিছুটান থাকবে না
ইংরেজিতে স্বরবর্ণ ছাড়া কোনও শব্দ হয়না, বাংলায়ও তা-ই কিন্তু গমন, চলন, গরজ, কথন, সহজ, গরম ইত্যাদি শব্দে স্বরবর্ণ বা স্বরচিহ্ন কোথায়? আছে স্বরবর্ণ অ বা অ-ধ্বনি এর প্রতিটি হরফে হরফে, সকলের সঙ্গে ওতপ্রোত বা সহজাত তাই অ-এর সাহজাত্য বর্জিত অবস্থা যে ঠিক কেমন হবে তা এই মুহূর্তে অনুমান করা একটু কঠিন
[Windows7, এবং Office Word7 environment-এ পড়লে সবটা ঠিক ঠিক পড়া যাবে
ফন্ট-- অহনলিপি-বাংলা১৪(AhanLipi-Bangla14)]
===
ঋণ:
বহু গ্রন্থ, পত্র পত্রিকা, অভিধান থেকে নানাভাবে সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে তাঁদের সকলের কাছে মুক্তকণ্ঠে ঋণ স্বীকার করি ও প্রণতি জানাই
১৭/০৯/২০১০
(সর্ব শেষ পরিমার্জন ১৬/০৪/২০১৬)
--০০--